মফিজ আলীর জীবন ও সংগ্রাম নতুন প্রজন্মের কাছে অনুকরণীয়

বাংলাদেশ ট্রেড ইউনিয়ন সংঘ কেন্দ্রীয় কমিটির সাবেক সহ-সভাপতি, মৌলভীবাজার জেলা কমিটির সাবেক সভাপতি, জাতীয় গণতান্ত্রিক ফ্রন্ট-এনডিএফ সাবেক কেন্দ্রীয় নেতা, সাম্রাজ্যবাদ সামন্তবাদ বিরোধী নেতা, ভাষা আন্দোলনের অন্যতম সংগঠক, প্রখ্যাত চা-শ্রমিক নেতা মফিজ আলী-এর ১৩-তম মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে ১০ অক্টোবর বাংলাদেশ ট্রেড ইউনিয়ন সংঘ মৌলভীবাজার জেলা কমিটির উদ্যোগে বিভিন্ন কর্মসূচির মাধ্যমে পালন করা হয়।
এদিন সকাল সাড়ে ১০ টার সময় বাংলাদেশ ট্রেড ইউনিয়ন সংঘ, জাতীয় গণতান্ত্রিক ফ্রন্ট, বাংলাদেশ কৃষক সংগ্রাম সমিতি, ধ্রুবতারা সাংস্কৃতিক সংসদ, গণতান্ত্রিক মহিলা সমিতি, হোটেল শ্রমিক ইউনিয়ন, চা শ্রমিক সংঘ, রিকশা শ্রমিক ইউনিয়ন, হকার্স ইউনিয়ন ও স’মিল শ্রমিক সংঘসহ বিভিন্ন সংগঠন ও ব্যক্তিবর্গের পক্ষ থেকে কমলগঞ্জ উপজেলার শ্রীসূর্য-ধূপাটিলাস্থ প্রয়াত নেতার সমাধিতে পুস্পস্তবক অর্পণ এবং প্রয়াত নেতার অসমাপ্ত কাজকে অগ্রসর করে নিয়ে যাওয়ার প্রত্যয়ে শপথ গ্রহণ করা হয়।
পরে স্থানীয় মাঠে বাংলাদেশ ট্রেড ইউনিয়ন সংঘ মৌলভীবাজার জেলা কমিটির উদ্যোগে এক আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়। সংগঠনের জেলা সভাপতি মোঃ নুরুল মোহাইমীনের সভাপতিত্বে ও সাধারণ সম্পাদক রজত বিশ্বাসের পরিচালনায় সভায় বক্তব্য রাখেন বাংলাদেশ ট্রেড ইউনিয়ন সংঘ সিলেট জেলা কমিটির যুগ্ম-সম্পাদক শ্রমিকনেতা রমজান আলী পটু, ধ্রুবতারা সাংস্কৃতিক সংসদ মৌলভীবাজার জেলা কমিটির সম্পাদক অমলেশ শর্ম্মা, প্রয়াত নেতার অনুজ রেজাউল করিম, বিশিষ্ট বাম রাজনীতিবিদ ও সাংবাদিক ডা. আব্দুল হান্নান চিনু, জাতীয় গণতান্ত্রিক ফ্রন্ট মৌলভীবাজার জেলা কমিটির সহ-সাধারণ সম্পাদক মোঃ মোস্তফা কামাল, গণতান্ত্রিক মহিলা সমিতি মৌলভীবাজার জেলা কমিটির যুগ্ম-আহবায়ক আম্বিয়া বেগম, হোটেল শ্রমিক ইউনিয়নের জেলা সম্পাদক মোঃ শাহিন মিয়া, রিকশা শ্রমিক ইউনিয়নের সভাপতি সোহেল আহমেদ, চা শ্রমিক সংঘের নেতা নারায়ন গোড়াইত, হকার্স ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক মোঃ শাহজাহান মিয়া, রিকশা শ্রমিকনেতা দুলাল মিয়া ও চা-শ্রমিকনেতা সীতারাম বীন প্রমুখ।
সভায় বক্তারা বলেন, করোনার অজুহাতে শিল্প কল-কারখানা, শ্রমিক, শহরের বস্তিবাসী শ্রমজীবী, কর্মজীবী এমনকি মধ্যবিত্ত পেশাজীবীদের লকডাউনের নামে কর্মহীন করে এক নিদারুণ পরিস্থিতির মুখে ঠেলে দিয়ে বেকারত্বের বোঝা বৃদ্ধি করে গ্রামমুখী হতে বাধ্য করেছে। সাথে সাথে কর্মরত শ্রমিক-কর্মচারীদের বেতন কমিয়ে; কাজের সময় বৃদ্ধি করে নির্মম শোষণ করা হচ্ছে। করোনার কারণে গত এক বছরে আড়াই কোটি মানুষ নতুন করে দরিদ্র হয়েছেন এবং ৬২ শতাংশ শ্রমিক কাজ হারিয়েছেন। নিত্যপণ্যের লাগামহীন মূল্যবৃদ্ধির এই সময়ে সরকারের দায়হীন লকডাউন বা শাটডাউন কারণে শ্রমিক ও শ্রমজীবী মানুষের জীবন ও জীবিকা বিপর্যয়ের মুখে পড়েছে। করোনা মহামারিতে জনগণের দুর্ভোগ বাড়ার সাথে সাথে লুটপাটকারীদের অর্থবিত্ত বৈভব বেড়ে যাওয়ায় দেশে গত এক বছরে ১০ হাজার ৫১ জন নতুন কোটিপতির সৃষ্টি হয়েছে।
সভায় বক্তারা আরও বলেন, বাংলাদেশের শিল্প সেক্টরগুলোর মধ্যে সবচেয়ে কম মজুরি দেওয়া হয় চা-শ্রমিকদের, দৈনিক ১২০ টাকা হিসেবে মাসিক মাত্র ৩,৬০০ টাকা। অথচ চা-শ্রমিকের রক্ত ঘাম করা পরিশ্রমে রেকর্ডের পর রেকর্ড চা-উৎপাদন হচ্ছে, স্বাভাবিক কারণে মালিকের মুনাফাও ক্রমাগত বৃদ্ধি পাচ্ছে। কিন্তু মানবেতর জীবনযাপন করা শ্রমিকদের জন্য বাজারদরের সাথে সংগতি রেখে ন্যায্য মজুরির প্রদান করা হয় না। এর কারণ হচ্ছে মালিকগোষ্ঠি ও দালাল শ্রমিক নেতাদের অশুভ আতাত। চা-শ্রমিকরা আজ দালাল চা-শ্রমিক ইউনিয়নের কাছে জিম্মি, আর চা-শ্রমিক ইউনিয়নের নেতারা মালিকদের কাছে দাসখত দিয়ে নিজেদের আখের গোঁছাতে ব্যস্ত। যার কারণে ইউনিয়ননের নেতাদের বাড়ি-গাড়ি, অর্থ-বিত্ত বাড়লেও শ্রমিকদের মজুরি বাড়ে না। এমন কি ২০২০ সালেই দৈনিক ১২০ টাকা মজুরির মেয়াদ শেষ হয়ে গেলেও তারা মজুরি বৃদ্ধি জন্য পদক্ষেপ না নিয়ে মালিকদের কাছে অনুনয় বিনয় করতে থাকে। এই করোনা কালে যখন সারাদেশের শিল্পাঞ্চল বন্ধ ঘোষণা করা হয় তখনও চা-শ্রমিকরা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে উৎপাদনে সক্রিয় ছিলেন। অথচ চা-শ্রমিকদের মজুরি বৃদ্ধি বেলা মালিকরা করোনাকে অজুহাত হিসেবে দাঁড় করাতে পিছ পা হচ্ছে না। অথচ চা-শ্রমিকদের মজুরি বৃদ্ধি বেলা মালিকরা করোনাকে অজুহাত হিসেবে দাঁড় করাতে পিছ পা হচ্ছে না। দালাল নেতারা ৩০০ টাকা মজুরি করার কথা শ্রমিকদের মধ্যে প্রচার করলেও এখন মালিকদের সাথে আলোচনায় দৈনিক ১২০ টাকা মজুরি করতে পারাকেও তারা সাফাল্য বলছে। আবার তারাই মজুরি বোর্ডের প্রস্তাবিত দৈনিক ১২০ টাকার মজুরিতে স্বাক্ষরদানে বিরত থেকে নাটক করেছে। মালিকদের স্বার্থরক্ষাকারী সরকারের গঠিত মজুরি বোর্ড চা-শ্রমিকদের দৈনিক ৬৭০ টাকা মজুরিসহ ১১ দফা দাবি উপেক্ষা করে ১২০ টাকা মজুরির সুপারিশ সরকারের নিকট পেশ করেছে। মজুরি চুক্তির মেয়াদ উত্তীর্ণ হওয়ায়, বর্তমান দ্রব্যমূল্যের মাত্রাতিরিক্ত ঊর্ধ্বগতি ঘটায় এবং কোম্পানির অধিক মুনাফা অর্জনের প্রেক্ষাপটে যখন মজুরি বৃদ্ধির দাবি জুরালোভাবে তুলে ধরে যৌক্তিক মজুরি চুক্তি সম্পন্ন করার কথা তখন চা-শ্রমিক ইউনিয়নের নেতারা ইউনিয়নের আগামী নির্বাচনে কে কিভাবে আখের গোছাবে তা নিয়ে ব্যস্ত। এমনকি চুক্তিতে চা-শ্রমিকদের গ্র্যাচুয়েটি, গ্রুপ বীমা চালু করার সিদ্ধান্ত থাকলে তারা তা বাস্তবায়নে কোন ভূমিকা নেয়নি। শুধু তাই নয় শ্রমআইনের ২৩৪ ধারায় কোম্পানি লভ্যাংশের ৫% অংশগ্রহণ তহবিল ও কল্যাণ তহবিলে প্রদান করার বাধ্যবাধকতা থাকলেও মালিক গোষ্ঠি শ্রমিকদের বঞ্চিত করে চলছে, দালাল নেতৃত্বও নিরবতা পালন করে মালিকের স্বার্থ রক্ষা করে চলেছে। দালালদের এই শ্রমিকস্বার্থ বিরোধী তৎপরতা বিপরীতে শ্রমিকস্বার্থে ভূমিকা গ্রহণকারী নেতৃত্বের উপর মালিকপক্ষ, দালাল নেতৃত্ব ও সরকার সমন্বিত হয়ে আক্রমণ চালায়। সিলেটের মালনীছড়া চা-বাগান, কালাগুল চা-বাগান ও মৌলভীবাজারের সুনছড়া চা-বাগানে শ্রমিক স্বার্থে ভূমিকা নেওয়া নেতৃত্বের উপর আক্রমণ করে বিপর্যস্ত করার প্রচেষ্ঠা চালিয়েছে। ইতিহাসের অমোঘ সত্য যত আক্রমণই আসুক প্রকৃত শ্রমিক নেতৃত্বকে স্তব করা যাবে না।
সভায় বক্তারা প্রয়াত নেতার অসমাপ্ত কাজ শোষণহীণ সমাজ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে বৃহত্তর আন্দোলন সংগ্রাম গড়ে তোলার দৃপ্ত অঙ্গীকার ব্যক্ত করে বলেন মফিজ আলীর জীবন ও সংগ্রাম নতুন প্রজন্মের কাছে অনুকরণীয়। সংগ্রামী এই জননেতা ১৯২৭ সালের ১০ ডিসেম্বর মৌলভীবাজার জেলার কমলগঞ্জ উপজেলা শ্রীসূর্য-ধূপাটিলা গ্রামে জন্ম গ্রহণ করেন। দীর্ঘ ৬০ বছরের বেশি রাজনৈতিক জীবনে তিনি ছাত্র আন্দোলন, ভাষা আন্দোলন, ৬৯-এর গণ আন্দোলন, চা শ্রমিক আন্দোলন, বালিশিরা কৃষক আন্দোলনসহ বিভিন্ন গণতান্ত্রিক আন্দোলন সংগ্রামে নেতৃত্ব প্রদান করেন। তিনি বৃটিশ আমল, পাকিস্তান আমল ও বাংলাদেশ আমলে মোট ৭ বার কারাবরণ করেন। মার্কসবাদ-লেনিনবাদের আদর্শে বিশ্বাসী সাম্রাজবাদ সামন্তবাদ বিরোধীনেতা মফিজ আলী জননেতা হিসেবে শোষিত নির্যাতিত শ্রমিক কৃষক মেহনতি মানুষের মুক্তির লক্ষ্যে যেমন নিরলস সংগ্রাম করে গেছেন তেমনি তাঁর ক্ষুরধার লেখনীর মাধ্যমে সংশোধনবাদ, সুবিধাবাদীদের মুখোশ উন্মোচন করেছেন। তিনি ইংরেজি ডন, সংবাদ, ইত্তেফাক, সাপ্তাহিক জনতা, লালবার্তা প্রভৃতি পত্রিকায় লেখালেখি করতেন। তিনি গণতন্ত্রের নির্ভীক মূখপত্র সাপ্তাহিক সেবা পত্রিকায় মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত ধারাবাহিকভাবে লেখেছেন। ২০০৮ সালে ১০ অক্টোবর সংগ্রামী এই জননেতা ৮১ বছর বয়সে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।
প্রেসবিঞ্জপ্তি