মুক্তি পেয়েও দেশে ফিরতে পারছে না তিন তরুণ

বিশেষ প্রতিনিধি
অবৈধ অনুপ্রবেশের দায়ে ভারতের জম্মু কাশ্মীরে চার বছর জেল কেটেছে সুনামগঞ্জের তিন তরুণ। সাত মাস আগে মুক্তি পেলেও বাংলাদেশী পরিচয়হীন এই তরুণরা বাড়ি ফিরতে পারছে না। ভারতীয় পুলিশ তাদের পুশব্যাকও করছে না। ভারতের জম্মু কোট ভালওয়াল জেলে কারা হেফাজতেই আছে এরা। সুযোগ পেলেই বাবা-মাকে ফোন দিয়ে তাদের উদ্ধারের জন্য কান্নাকাটি করছে ওখানে আটক তরুণ মোহাম্মদ আলী। দরিদ্র দিনমজুর পরিবার এদের উদ্ধারে কিছুই করতে পারছে না।
সোমবার রাতে ভারতের জম্মু কাশ্মীরের কোট ভালওয়াল কারাগার থেকে ফোনে এই প্রতিবেদকের সঙ্গে কথা বলে ওখানে আটক সুনামগঞ্জের তরুণ মোহাম্মদ আলী। পৌর এলাকার জলিলপুরের নুরুল হকের ছেলে সে। ভারতীয় ফোন নম্বর ০৯১৩৩৪০১২৭৫০০ থেকে এই প্রতিবেদককে ফোন দিয়ে কাঁদতে থাকে মোহাম্মদ আলী।
বললো, সাত ভাই দুই বোনের সংসার আমাদের। অভাব অনটন লেগেই থাকতো। এই অবস্থায় বাবা-মাকে না জানিয়েই অন্য দুই বন্ধুকে নিয়ে কাজের উদ্দেশ্যে দেশ ছাড়ি আমরা। হাতে কোন টাকা ছিল না। সুনামগঞ্জ থেকে সামান্য কিছু টাকা নিয়ে রওয়ানা দেই। পরে পথে পথে কাজ করে কিছু টাকা উপার্জন করে আবার গাড়িতে ওঠে রওয়ানা দিয়েছি, এভাবে এসেছি জম্মু কাশ্মিরে। জম্মু কাশ্মিরে পৌঁছার আগে পর্যন্ত যেখানে টাকা শেষ হয়েছে সেখানেই দিনমজুরের কাজ করেছি। টাকা হলেই আবার রওয়ানা দিয়েছি। পথের অনেক স্থানের নাম ভুলেই গেছি। জম্মু কাশ্মির সীমান্তে পৌঁছার পর বিএসএফ আটকায়। জিজ্ঞেস করলে সত্য কথাই বলতে থাকি। পরে চার বছরের জেল হয় আমরা তিনজনের। সাত মাস আগে মুক্তি পেয়েছি। কিন্তু আমরা যে বাংলাদেশী এই প্রমাণ আমাদের কাছে নেই।
মোহাম্মদ আলী জানায়, কারাগারে গ্রেপ্তার হওয়া তিনজন একসঙ্গে থাকলেও এখন তাদেরকে ভিন্ন ভিন্ন স্থানে রাখা হয়েছে। নিজেদের মধ্যে এখন আর যোগাযোগ নেই তাদের। তবে জম্মু কোট ভালওয়াল পুলিশ তাদের সহযোগিতা করছে, বাংলাদেশে পরিবারের কাছে ফোন করতে দিচ্ছে। খাবার-দাবারও দিচ্ছে। কেবল বাইরে যেতে দিচ্ছে না।
মোহাম্মদ আলী জানালো, তার সঙ্গে ওখানে জেল খাটা অন্য দুই তরুণ হচ্ছে একই গ্রামের সুলতান মিয়ার ছেলে জাহাঙ্গীর আলম (২২) ও জাউয়া বাজারের আব্দুর রহিমের ছেলে আব্দুল করিম।
মোহাম্মদ আলীর বাবা নুরুল হক ও আলতাবুন নেছা নিখোঁজ ছেলের খুঁজে প্রথম দুই তিন বছর বিভিন্ন স্থানে গিয়েছেন। না পেয়ে অঝোর ধারায় মাসের পর মাস চোঁখের পানি ঝড়িয়েছেন মা আলতাবুন নেছা।
সাত মাস আগে হঠাৎ একদিন বড় ভাই বরকত আলীর মুঠোফোনে কথা বলে মোহাম্মদ আলী।
ফোনে জানায়, সে (মোহাম্মদ আলী) ভারতের জম্মু কোট ভালওয়াল কারাগারে আছে। সে যে বাংলাদেশী এই পরিচয় পেলেই বাংলাদেশে পাঠিয়ে দেওয়া হবে তাকে। তারা যেন পরিবারের পক্ষ থেকে যোগাযোগ করে তাদের আনার ব্যবস্থা করে। কিন্তু দরিদ্র দিনমজুর পরিবারের সদস্যরা এই বিষয়ে কিছুই করতে পারছে না।
মোহাম্মদ আলী’র বাবা নুরুল হক বললেন, অশিক্ষিত মানুষ আমরা কিছুই জানি না, বুঝি না। ছেলেটি যখন ফোন দিয়ে বলে, ‘বাবা আমাকে ছাড়াবে না’ তখন আমি পাগলের মতো কাজ কর্ম ফেলে এখানে যাই, ওখানে যাই, কিন্তু করতে পারছি না কিছুই। তার সঙ্গে আরও যে দু’জন গেছে, এদের কেউ নাই বললেই চলে। তারা আমার চেয়ে আরও অসহায়। ওদের বাড়িতে কেউ নেই। বললেন, আপনারা একটু সহযোগিতা করলে আমার ছেলেটি উদ্ধার হবে। তিনি জানান, তার ছেলে দেশ ছাড়ার সময় জাতীয় পরিচয়পত্র করার বয়স হয় নি। তবে জন্ম নিবন্ধন আছে। সুনামগঞ্জ পৌরসভার দেওয়া জন্ম নিবন্ধনে ওই তরুণের জন্ম তারিখ উল্লেখ আছে ২৮ মার্চ ২০০২ খ্রি, (জন্ম নিববন্ধন নম্বর ২০০২৯০২৬০০৯১০৮২৮৫)
সুনামগঞ্জ পৌরসভার সংশ্লিষ্ট ওয়ার্ডের কাউন্সিলর গোলাম আহমদ বললেন, মোহাম্মদ আলীকে আমি চিনতাম। তার বাবা নুরুল হক আমার ওয়ার্ডের স্থায়ী বাসিন্দা। তিনি তার ছেলের বিষয়টি আমার কাছে এসেও জানিয়ে সহযোগিতা চেয়েছেন। জাহাঙ্গীর আলম ও তার বাবা সুলতান মিয়াকে আমি চিনি। এরা আমার ওয়ার্ডের জলিলপুরের বাসিন্দা। জাহাঙ্গীরের বাবা সুলতান মিয়া বয়সের ভারে ন্যুব্জ। জাহাঙ্গীরের মা আমাকে জানিয়েছেন, তার ছেলেও জম্মু কাশ্মিরের কারাগারে আটক আছে।
জাউয়া বাজার ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আব্দুল হক জানালেন, তার ইউনিয়নের কেউ এভাবে এসে খোঁজ খবর নেয় নি। কোন গ্রামের জানতে পারলে তিনি খোঁজ খবর নিয়ে সহযোগিতার চেষ্টা করবেন।
সুনামগঞ্জের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (মিডিয়া) রিপন কুমার মোদক বললেন, জন্মনিবন্ধন বা জাতীয় পরিচয়পত্র সহ আটকে পড়াদের পরিবারের পক্ষ থেকে জেলা ম্যাজিস্ট্রেট (জেলা প্রশাসক) এবং পুলিশ সুপারের কাছে আবেদন করলে, এদের ফিরিয়ে আনার প্রক্রিয়া শুরু হতে পারে।