রাজনীতিবিদদের আস্থার সংকট ও অর্থনীতির উল্টোযাত্রা

বিশ্ব ব্যাংকের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক কৌশিক বসু ঢাকার এক আলোচনা সভায় বলেছেন, ‘রাজনীতিবিদদের জন্য মানুষের আস্থা অর্জন খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এটি দ্রুত অর্থনৈতিক উন্নয়নে ভূমিকা রাখে। অন্যদিকে সবকিছু ঠিক থাকলেও মানুষের মধ্যে এই আস্থা না থাকলে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি কমে যাওয়ার মতো ঘটনা ঘটতে পারে’। শুক্রবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আর.সি. মজুমদার মিলনায়তনে অনুষ্ঠিত আলোচনা সভায় তিনি এ কথা বলেছেন। ড. বসু একেবারে যথার্থ বলেছেন বলে আমরা মনে করি। যেহেতু অর্থনীতিই রাজনীতিকে নিয়ন্ত্রণ করে এবং রাজনীতিবিদদের হাত ধরে নিয়ন্ত্রিত হয় অর্থনৈতিক কর্মকা- সেহেতু রাজনৈতিক নেতৃত্বকে আস্থার জায়গায় না থাকলে অর্থনীতির চাকা পিছনে ঘুরবে। আমাদের দেশে অভূতপূর্ব অর্থনৈতিক উন্নয়ন ঘটেছে গত এক দশকে। জিডিপি, মাথাপিছু জাতীয় আয় বা অন্যান্য সূচকে এই অগ্রগতি বেশ আশাব্যঞ্জক। উন্নয়নের সুষম অবস্থা নিয়ে প্রচুর কথা বলার সুযোগ থাকলেও অসম উন্নয়নের ফলাফলও সাধারণ মানুষ কিছুটা ভোগ করতে পারে। বাংলাদেশে এখন ক্ষুধাতাড়িত মানুষ খুব বেশি দেখা মিলে না। মানুষের কর্মসংস্থানের বহু সুযোগ তৈরি হয়েছে। অবকাঠামোগত উন্নয়ন হচ্ছে ব্যাপকভাবে। দেশের বাজেটের আকার লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে। এসবই দেশটির রাজনৈতিক নেতৃত্বের প্রশংসনীয় অর্জন বটে। কিন্তু ড. কৌশিক বসু যা বলেছেন অর্থাৎ রাজনীতিবিদদের প্রতি সাধারণ মানুষের আস্থার সংকট; সেটি এখন ধীরে হলেও ফুটে উঠতে শুরু করেছে। বিশেষ করে গেল বছর থেকে ব্যাংক খাতে ঋণের নামে বিশাল পরিমাণে অর্থ আত্মসাৎ ও বিদেশে অর্থ পাচারের বড় বড় কেলেংকারির খবর বেরিয়ে আসতে শুরু করেছে। অভার ও আন্ডার ইনভয়েসিং করে বিপুল অংকের মুদ্রা বিদেশে পাচারের খবরও প্রকাশিত হচ্ছে। বহুমুখী বিশাল বিশাল দুর্নীতি তো এখন মহোৎসব করছে। এই অবস্থা দেশের অর্থনীতির লুটেরা চেহারাকে প্রকটিত করে। রাজনৈতিক নেতৃত্ব সঠিক অবস্থান বজায় রাখলে এত বেপরোয়া লুটপাট চালানোর কোনো অবস্থা তৈরি হতে পারে না। ড. বসুর মতামত অনুসারে এর নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া পড়বে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির উপর।
সপ্তদশ শতকে কবিচন্দ্র কর্তৃক বাংলায় অনুবাদকৃত রামায়ণের এক জায়গায় এমন একটি স্তবক আছেÑ‘রাজার পাপে রাজ্য নষ্ট প্রজা কষ্ট পায়’। অর্থাৎ রাজা যদি পুণ্যবান না হয় তাহলে সে রাজ্যের প্রজারা অশেষ কষ্টের সম্মুখীন হন। ড. কৌশিক আজ যখন আস্থাহীনতার সংংকট বিষয়ে কথা বলছেন; আমরা দেখতে পাই প্রায় পাঁচ শ’ বছর আগে একই ধরনের কথা বলে গেছেন আমাদের পূর্বপুরুষরা। অর্থাৎ সেই তিন শ’ বছর আগে কিংবা পরের সামাজিক বাস্তবতায় এই প্রপঞ্চটি গতিশীল ছিলোই। রাজনীতি ও অর্থনীতি পরষ্পর সম্পর্কিত। হরিহর আত্মা। এরা উভয়ে মিলিত হয়ে ভালো এবং মন্দ দুই-ই করতে পারে। অর্থনীতির দুশ্চরিত্র যদি রাজনীতিবিদকে কলুষিত করে তাহলে এরা দুইয়ে মিলে যা উৎপাদন করবে তাতে প্রজা সাধারণের কষ্টের শেষ থাকে না। সুতরাং আশু কর্তব্য হলো রাজনীতি ও অর্থনীতির চালিকাশক্তিকে সুপথে ফেরানো। নতুবা একটা সময়ে যে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি আমাদের খুশির কারণ হয়েছিলো তা হুছট খেয়ে উল্টোযাত্রা শুরু করতে পারে। এমন অবস্থা আমরা আর্জেন্টিনা, শ্রীলঙ্কাসহ আরও বহু দেশের ক্ষেত্রে দেখেছি।
ড. কৌশিক বসু মূলত নতুন কোনো তত্ত্বকথা বলেননি। একেবারে স্বতসিদ্ধ একটি মৌলিক শর্তের কথা সকলকে মনে করিয়ে দিয়েছেন। জটিল বিশ্বপরিস্থিতিতে সামনের দিনগুলো আরও ভয়াবহ হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। সে জায়গায় দেশ পরিচালনার দায়িত্বপ্রাপ্ত রাজনীতিকরা যদি জনগণের আস্থার জায়গায় না আসেন অর্থাৎ নিজেদেরকে ব্যাপক জনগোষ্ঠীর কলাণে নিবেদিত না করেন তাহলে সামনে বড় রকমের বিপদ অপেক্ষা করছে তা বলাই বাহুল্য।