রেশনিং ব্যবস্থা চালুর দাবি যৌক্তিক

ট্রেড ইউনিয়ন সংঘ নামের একটি শ্রমিক সংগঠন সর্বাত্মক রেশনিং ব্যবস্থা চালুর দাবিতে মঙ্গলবার শহরে একটি বিক্ষোভ মিছিল-সমাবেশ করেছে বলে গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদ থেকে জানা যায়। তারা বলেছে, তেল-গ্যাসসহ নিত্যব্যবহার্য সকল জিনিসপত্রের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধির কারণে সাধারণ মানুষের জীবনে চরম কষ্ট নেমে এসেছে। দেশের বাস্তব অবস্থা কিন্তু তাই। মানুষের জীবন ধারণের জন্য প্রয়োজনীয় অধিকাংশ জিনিসের দাম অস্বাভাবিকভাবে বাড়ছে। কিছু জিনিসের দাম দ্বিগুণ হয়ে গেছে। সরকারের পক্ষ থেকে এজন্য রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের পরিণতিতে সৃষ্ট আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক মন্দাবস্থার কথা বলা হলেও এর পিছনে দেশীয় অতিমুনাফাখোর শিল্পগোষ্ঠী ও অসৎ ব্যবসায়ীদের কারসাজি এবং ভুল জাতীয় নীতির বিষয়টিকে আড়াল করে রাখা হয়। এরকম অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধিকে কেবল যুদ্ধের উপজাত ভাবা সঠিক নয়। প্রকৃত কারণকে এতে আড়াল করা হয়। যুদ্ধ ও অর্থনৈতিক মন্দা একটি বড় কারণ বটে। কিন্তু পুঁজিবাদী অর্থনীতির দুষ্টচরিত্র যা রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধেরও বড় কারণ; তাকে সামনে না আনার অর্থ হলো শাসকগোষ্ঠীর অক্ষমতা-দুর্বলতা-অসহায়ত্বকে আড়াল করে রাখা। সংগত কারণেই এতে মানুষের ক্ষোভ ও বিক্ষোভ তৈরি হবে। সম্প্রতি বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর সভা-সমাবেশে লক্ষণীয় জনসমাগমের মূল কারণ যতটা না ওই রাজনৈতিক দলের প্রতি সমর্থন তারচাইতে বেশি হলো অর্থনীতি ও বাজারের এই আগ্রাসী ও নিপীড়নমূলক চরিত্র।
ক্রমাগত জিনিসপত্রের দাম বাড়ার পেক্ষিতে সাধারণ মানুষের আয় বাড়ার কোনো লক্ষণ নেই। শ্রমিকদের মজুরি বাড়েনি কোনো খাতে, চাকুরিজীবীদের বেতন বাড়েনি। অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে নিয়োজিত শ্রমিক-কর্মচারি, কৃষক, ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা, ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের মজুরি ও দৈনিক আয়ও বাড়েনি। ফলে উচ্চবিত্ত শ্রেণি বাদে দেশের সকল মানুষই দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির অভিঘাতে আজ দিশেহারা। সরকারকে মানুষের এই অসহায় অবস্থা বিবেচনার মধ্যে নিতে হবে। ওএমএস, টিসিবির মাধ্যমে পণ্য বিক্রি, সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচির বিভিন্ন কর্মসূচী প্রভৃতির মাধ্যমে সরকার কিছু সহায়তা করছে বটে তবে তা প্রয়োজনের তুলনায় নেহায়েৎই অপ্রতুল। ওএমএস কার্যক্রমের চলমান পদ্ধতি নিয়ে সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রী অসন্তোষ প্রকাশ করে কার্ডের মাধ্যমে উপযুক্ত উপকারভোগীদের কাছে পণ্য বিক্রির ব্যবস্থা চালু করতে নির্দেশনা দিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রীর এই নির্দেশনাটি বাস্তবতার প্রেক্ষিতে অত্যন্ত উপযোগী। রেশনিং ব্যবস্থা চালুর দাবিটি এই নির্দেশনার সাথে সম্পর্কিত। জীবন ধারণের জন্য অপরিহার্য কিছু পণ্য প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর নিকট কম দামে সরবরাহ করার ব্যবস্থা পৃথিবীর বহু দেশে চালু আছে। আমাদের দেশেও একসময় এ ব্যবস্থা ছিলো। দেশের স্বল্পবিত্ত জনগোষ্ঠীকে রেশনিং ব্যবস্থার মধ্যে আনা না হলে তাদের কষ্ট অসহ্য অবস্থায় চলে যাবে।
বিশ্বমন্দাকে মোকাবিলা করার জন্য সরকার কৃচ্ছ্রতা সাধনের নীতি অবলম্বন করে অপ্রয়োজনীয় খরচ কমানোর নীতি গ্রহণ করেছেন। কার্যত এ নীতির প্রতিফলন এখনও তেমন করে দেখা যাচ্ছে না। সাধারণ মানুষের জীবনে স্বস্তি আনার পরিবর্তে বহু অপ্রয়োজনীয় খরচের ছড়াছড়ি দেখছি আমরা। সরকারের উচিৎ অবিলম্বে অপ্রয়োজনীয় ব্যয় সংকোচনের মাধ্যমে মানুষের বেঁচে থাকার ন্যূনতম পণ্যসমূহ (যেমনÑচাল-আটা, ডাল, তেল, শিশুখাদ্য, পেঁয়াজ ইত্যাদি) স্বল্পমূল্যে জনগণের নিকট পৌঁছে দেয়া। এ কাজটি দ্রুত শুরু করা গেলে সরকার অযাচিত জনবিক্ষোভের হাত থেকে রেহাই পাবে বরং উল্টো জনসন্তুষ্টির একটি বাড়তি বোনাস তাদের থলিতে যোগ হবে। চলমান পরিস্থিতিতে মানুষের অভাববোধ এমন এক পর্যায়ে চলে যাওয়ার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে যা আমাদের কথিত অর্থনৈতিক অগ্রগতি তথা মধ্যম আয়ের দেশের বৈশিষ্ট্যের সাথে বেমানান। ওএমএস লাইনের ভিড়ের চিত্রগুলো জাতীয় ও আন্তর্জাতিক মিডিয়ায় প্রচারের কারণে এ নিয়ে সবমহলে ভুল বার্তা পৌঁছাচ্ছে। সুতরাং ভাবমূর্তি রক্ষার তাগিদ থেকেও মানুষের তীব্র অভাববোধকে সংযত করা দরকার।
তাই অবিলম্বে দেশের স্বল্পবিত্ত জনগোষ্ঠীকে সাধারণ রেশনিং ব্যবস্থায় আনার যে দাবি উঠেছে তা বিবেচনায় আনা উচিৎ বলে আমরা মনে করি।