‘শতবর্ষে বরুণ রায়ের আদর্শ প্রেরণা হউক’

রমেন্দ্র কুমার দে মিন্টু
এ বছর ২০২২ সাল। ঠিক ১০০ বছর পূর্বে ১০ নভেম্বর ১৯২২ সালে জন্ম নিয়েছিলেন প্রসূণ কান্তি রায় বরুণ রায় জামালগঞ্জ উপজেলার বেহেলী গ্রামের পিতা করুণাসিন্ধ রায়ের জমিদার পরিবারে। আমাদের প্রিয় বরুণদা চলে গেলেন ৮ই ডিসেম্বর ২০০৯ খ্রি. হাছননগর নিজ বাসভবনে।
পৈত্রিক সূত্রেই জমিদারী প্রথার প্রতি লোভ এবং আরাম আয়েশে জীবন কাটানো বিসর্জন দিয়ে সাম্যবাদ, মানবতা, ত্যাগের রাজনীতি নিয়ে শোষণহীন সমাজ প্রতিষ্ঠার লক্ষে অর্থনৈতিক মুক্তির আদর্শ নিয়ে জীবন সংগ্রাম করে গেছেন। তিনি তার জীবন যৌবনের শ্রেষ্ঠ সময় এদেশের মানুষের কল্যাণে উৎসর্গ করেছেন। তাঁর রাজনীতির লক্ষ্য ছিলো জীবনের ত্যাগ তিথিক্ষা, প্রগতিশীল আদর্শে দীক্ষিত, সমাজের অধিকার বঞ্চিত অসাম্প্রদায়িক সমাজ প্রতিষ্ঠা করা।
তার পিতা করুণাসিন্ধ রায় কৃষক আন্দোলনে জমিদারী ত্যাগ করে ১৯৩৮ সালে শত শত কৃষক ও বাপন্থী কর্মীদের নিয়ে দীর্ঘ ৮৬ মাইল পায়ে হেঁটে শিলং পর্যন্ত লং মার্চ করে ‘প্রজাস্বত্ব’ বিল পাশ করেন।
প্রগতিশীল ছাত্র ফেডারেশনের কর্মী হিসাবে বরুণ রায় কমিউনিস্ট পার্টির সংস্পর্শে আসেন এবং ১৯৪২ সালে মাত্র ২০ বছর বয়সে পার্টির সদস্যপদ লাভ করেন। এ রাজনীতির লড়াইয়ে তিনি জেল-জুলুম-হুলিয়া আর নির্যাতন সহ্য করেছেন। তার জীবনে ১৪টি বছর নির্জন কারাবাসে কেটেছে। ১৯৪৯ সাল থেকে বিভিন্ন সময় ১৯৮৭ সাল পর্যন্ত কমপক্ষে ৫বার তাঁকে গ্রেফতার করা হয়। ১৯৫৪ সালে পূর্ব পাকিস্তান পরিষদে তিনি বিপুল ভোটে নির্বাচিত হন। ১৯৮৬ সালে সুনামগঞ্জ-১ আসনে কমিউনিস্ট পার্টির প্রার্থী হিসেবে এমপি নির্বাচিত হন।
১৯৬৮-৬৯ সালে গণআন্দোলনের সময় তিনি প্রকাশ্যে চলাফেরা থেকে বিরত থেকে গোপনে পার্টির কাজের মাধ্যমে গণআন্দোলনের নেতৃত্ব দেন। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে তিনি সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন এবং নেতৃত্ব দেন। বঙ্গবন্ধু হত্যার পরই মুক্তিযুদ্ধের চেতনার উপর আঘাত আসতে থাকে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনার কথা অহরহ শোনা যায় কিন্তু চেতনাটা কি? মুক্তিযুদ্ধের লক্ষ্যে জাতি যে চেতনায় ঐক্যবদ্ধ হয়েছিল হিন্দু-মুসলিম-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান নির্বিশেষে অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক চেতনা। এর মধ্যে সব ধরনের বৈষম্যমুক্ত সমতাভিত্তিক উদার মানবিক চেতনা ছিল। গত চার দশকে সমাজ চর্চার দিকে এবং রাজনীতিতে ধর্মের ব্যবহার সাম্প্রদায়িকতার বিভাজন বিদ্দেষ স্পষ্ট। দেশের সংবিধান আক্রান্ত হলো মৌলিক অনেক পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে, তার অখ-তা হারাল, আবার সাম্প্রদায়িকতা, উগ্রতা ফিরে এলো। পাকিস্তানের ভাবধারায় প্রত্যাবর্তন ঘটল। মৌলবাদিরা ভারতবিরোধীতা, হিন্দু বিরোধীতা, বাঙালি সংস্কৃতির বিরোধীতা ও নারী বিদ্ধেষ এই চারটি স্তম্ভের উপর দাঁড়িয়ে কাজ শুরু করে দিল।
সোভিয়েত ইউনিয়নের আন্তর্জাতিক অঙ্গনে প্রগতিশীল আন্দোলনে যে আঘাত আসল বাংলাদেশেও এর প্রভাব থেকে মুক্ত নয়। বরুণদার শেষ বয়সে এসে পার্টি মধ্যে বিভেদ হওয়ায় তখন থেকে আর বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখা সম্ভব হয়নি কিন্তু তিনি মৃত্যুর আগ পর্যন্তও মুক্তিযুদ্ধের চেতনার কথা বলেছেন এবং বলতেন রাজনীতিতে উত্থান পতন তো আছেই। তিনি বিশ্বাস করতেন একদিন দেশ আবার ঘুরে দাঁড়াবে।
বঙ্গবন্ধুর আদর্শের কথা শুনা যায়। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর আদর্শ কতটুকু রক্ষা করা হচ্ছে! বঙ্গবন্ধুর ১০ জানুয়ারি ১৯৭২ সালের ভাষণটাও ভীষণ তাৎপর্যপূর্ণ। তাতে তিনি বাংলাদেশ কেমন দেখতে চেয়েছিলেন তার রূপকল্প তুলে ধরেছেন। তিনি বলেন, এ স্বাধীনতা আমার পূর্ণ হবে না, যদি বাংলার মানুষ পেট ভরে ভাত না খায়। এ স্বাধীনতা আমার পূর্ণ হবে না যদি বাংলার মা-বোন কাপড় না পায়, এ স্বাধীনতা আমার পূর্ণ হবে না যদি এদেশের যুবক যারা আছে তারা চাকুরি না পায়।…
একটা কথা! আজ থেকে বাংলায় যেন আর চুরি-ডাকাতি না হয়। বাংলায় যেন আর লুটতরাজ না হয়। আমার রাষ্ট্র হবে সমাজন্ত্র ব্যবস্থা। বঙ্গবন্ধু যে মুক্তির কথা উচ্চারণ করলেন কিন্তু তা অর্জনের পথটা কঠিন জেনেও তিনি মুক্তি অর্জনের কথা বললেন। মুক্তি অর্জনের জন্য প্রয়েজন সাম্য, সম্পদের সুষম বণ্টন, স্বাস্থ্য, শিক্ষা, অন্ন, বাসস্থানসহ সব অধিকারের সফল বাস্তবায়ন। সামাজিক ন্যায় বিচার এবং ব্যক্তির মর্যাদা প্রতিষ্ঠাও কাম্য। জাতপাতের বিভাজন দূর করা। ‘কেউ খুব বেশি ধনী হবে, সে আমি চাই না। আমি কমিউনিস্ট নই সমাজতন্ত্রীকরী, আমি দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফুটাতে চাই।’
বরুণদা সব সময় কৃষকদের পাশে থেকে বিভিন্ন ইস্যু নিয়ে আন্দোলন করেছেনÑ ব্রিটিশ তাড়ানো আন্দোলন থেকে এ উপমহাদেশে বহু বিপ্লবীরা রাজনীতিবিদেরা নির্লোভ রাজনীতি করতে গিয়ে জেল, জুলুম অত্যাচার সহ্য করেছেন। তাদের আন্দোলনের ফলেই ব্রিটিশরা এই উপমহাদেশ থেকে বিতাড়িত হয়েছে। কয়েক দশকে রাজনীতিতে একজন রাজনীতিক গণবিচ্ছিন্ন দূরের মানুষ। রাজনীতির মঞ্চে, মাঠে ময়দানে সাধারণের স্থান সংকুচিত। দলে মত প্রকাশের কোনো সুযোগ নেই। রাজনীতি এখন সম্পন্ন মানুষের ক্ষমতা চর্চার এবং উচ্চাভিলাসীর সম্পদ ও ক্ষমতা অর্জনের অবলম্বনমাত্র। তাদের প্রয়োজন টাকা, প্রয়োজন বিত্ত আর চাই ক্ষমতা। আদর্শ বা আত্ম মর্যাদা বিসর্জন দিয়ে হলেও তা চাই। এর বাইরে ক্ষমতা চর্চার জন্য তার একটি অন্তরঙ্গ চক্র থাকবে, যারা কর্মী হিসেবে পরিচিত হলেও প্রায়ই ক্ষমতার দাপটে বহিঃপ্রকাশ ঘটায়। নীতি-নৈতিকতা এবং ন্যায়-অন্যায়ের বাছবিচার না করে যে কোন মূল্যে ধন সম্পদ উপার্জনই মানব জীবনের একমাত্র লক্ষে পরিণত হয়েছে। এ কারণে এক শ্রেণির মানুষ সম্পদের পাহাড় গড়ে তোলার প্রতিযোগিতায় ব্যস্ত। আরেক শ্রেণি দিন-রাত খেটেও দু’বেলা অন্নের সংস্থান করতে পারছে না। আমরা দুটি চক্রে বাঁধা পড়েছি। একটি দুর্নীতি অন্যটি বৈষম্য। পুঁজি পাচারকারীরা জাতির ‘এক নম্বর দুশমন’। তারা যদি পুঁজি পাচার না করত তাহলে বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ায় মাথাপিছু জিডিপির বিচারে সবচেয়ে অগ্রগামী দেশে পরিণত হতো। বর্তমানে সংসদে ৭০ শতাংশ সাংসদ ব্যবসায়ী। সংসদের আইন প্রণয়নে তাদের ভূমিকা কার স্বার্থে হবে? বিচার ব্যবস্থা থেকে আমলাতন্ত্র, ব্যবসা-বাণিজ্য থেকে শিক্ষা ক্ষেত্রে সর্বত্র দুর্নীতির কথা শুনা যায়। আইনের শাসন সেখানে এখন আইন লঙ্ঘনের শাসন।
বরুণদা জনগণের পাশে থেকে তাদের সমস্যা সংকট নিয়ে আন্দোলন সংগ্রাম করেছেন। রাজনীতি, গণতন্ত্র, নির্বাচন সবকিছু জনগণের কল্যাণের জন্য। সেই জনগণে অভাব অভিযোগ অধিকার যদি রাজনীতিতে উপেক্ষিত থাকে, রাজনীতিক নেতারা তা আমলে না নেন, তাহলে সেই রাজনীতির প্রয়োজন কি? এখন আর জনগণের সমস্যা সংকট নিয়ে কেউ ভাবে না। কীভাবে ক্ষমতায় যাওয়া যায়, সেই তাদের একমাত্র ধ্যান জ্ঞান হয়ে পড়েছে। যারা জনগণের নামে রাজনীতি করে, তাদের প্রতি উপহাস ছাড়া কিছু নয়।
বরুণদা ছাত্র জীবনে ছাত্র ফেডারেশনের কর্মী হিসেবে কাজে যোগ দিয়েছেন। পরে রাজনৈতিক কর্মী-নেতা হয়েছেন। মানুষের পাশে থেকে কাজ করেছেন। প্রতিনিয়ত মানুষের সুখ-দুঃখের সাথী হয়ে নেতা হয়েছেন। স্বচ্ছ রাজনীতির ক্ষেত্রে স্বাধীন বাংলাদেশে এটাই প্রচলিত হওয়ার কথা ছিলো। ছাত্র রাজনীতির ক্ষেত্রে সে ইতিহাসও আমাদের আছে। ১৯৫২ সাসলের ভাষা আন্দোলন, আইয়ূব বিরোধী আন্দোলন, শিক্ষা কমিশন বিরোধী আন্দোলন, ৬৯ খ্রি ১১ দফা আন্দোলনসহ গণঅভ্যুত্থান এর মূল নেতৃত্বে ছিল এ দেশের ঐক্যবদ্ধ ছাত্র সংগঠনগুলো। ছাত্র সংগঠনের মধ্যে গণতান্ত্রিকভাবে নেতা নির্বাচিত করা হতো। বছর বছর প্রতিটি কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে নির্বাচনের মধ্যেমে ছাত্র-সংসদ গঠন করা হতো। তখনকার ছাত্র নেতারাই পরবর্তীতে দেশের রাজীনিতক নেতা হয়েছেন। এই অবস্থার মধ্যেও ছাত্র নেতাদের নেতা হিসেবে তাদের যোগ্যতার পরিচয় দিয়েছে। শিক্ষাক্ষেত্র নিয়ে বর্তমানের মতো এতো দুঃশ্চিন্তার বিষয় ছিল না। প্রতিটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে সাধারণ শিক্ষার্থীদের ওপর নিপীড়ন, চাঁদাবাজি, সীট বাণিজ্য, মাস্তানিসহ নানা ধরণের অন্যায় ও অপরাধমূলক কর্মকা- করে ছাত্র নেতারা পায় পেয়ে যায়। তাদের বিরুদ্ধে কেউ কোনো শব্দ উচ্চারণ করতে পারে না। কারণ তাদের পাল্টা নিগৃহীত হতে হয়। আরও শঙ্কার বিষয় হলো, আমাদের দেখতে হচ্ছে যে দলই ক্ষমতায় যায়, সে দলই ছাত্র রাজনীতিকে তাদের ক্ষমতার স্বার্থে অন্যায়ভাবে ব্যবহার করতে বিন্দুমাত্র দ্বিধা করে না। সবচেয়ে সম্ভাবনাসময় ও শক্তিশালী এই জনগোষ্ঠীর সামনে সুস্থ রাজনীতি চর্চা কিংবা নেতৃত্ব বিকাশের পথের দিশা রাখা হয় না। বাধাহীনভাবে অন্যায় অবৈধ সুযোগ পেতে পেতে ছাত্র নেতারা কীভাবে ভিন্ন পথে অর্থনৈতিক ক্ষমতার স্বাদা গ্রহণ করা যাবে, সেই চিন্তায় মত্ত থাকে। এখন পড়াশোনা বা গবেষণা এখন গৌন বিষয়, বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এখন শিরোনাম হয় প্রধান ছাত্রবাসে নির্মম নির্যাতন, ভিন্নমতের ওপর অকথ্য আক্রমণ, যৌন নির্যাতন বা দুর্নীতির কারণে। উচ্চশিক্ষার উৎকর্ষ কেন্দ্র নয়, তাহলে ক্ষমতা ধরে রাখার দূর্গ হিসাবে অল্গকিছু শিক্ষার্থী তাদের ক্ষমতার স্বার্থে এ ধরনের অনুচিত ও অপরাধমূলক কর্মকা-ের সঙ্গে জড়িত হচ্ছে। বাস্তবতা হচ্ছে তারাইতো ভবিষ্যতে দেশ পরিচালনা করবে, সমাজ ও প্রশাসনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে নেতৃত্ব দেবে। আমাদের শিক্ষাবিদেরা যা বলেন না- তারা সমস্যার মূলে না গিয়ে আশপাশ দিয়ে যান, গা বাঁচিয়ে কথা বলেন। আর শিক্ষার যারা অভিভাবক হয়ে বসেছেন তারা ভাবেন দেশের মানুষ নির্বোধ, তাদের যা বোঝানো হবে তাই বুঝবেন, যা শেখানো হবে, তাই শিখবেন। কোনো বিষয়ে প্রশ্ন করা যাবে না, করলেও কখনো উত্তর মিলবে না।
বরুণদা স্বপ্ন দেখেছিলেন বাংলাদেশ উন্নত দেশ হবে। উন্নত দেশ হিসেবে আমাদের চিন্তা চেতনায়, সামাজিক অবস্থায়, উদারতায়, সহনশীলতায়, সুশাসনের মাধ্যমে শোষণমুক্ত সমাজ গড়ে তুলবেন। কিন্তু তাতে হুচট খেলেও দেশ এ অবস্থায় বেশি দিন থাকবে না। তিনি হতাশ হননি। তিনি বলতেন একদিন এ অবস্থার পরিবর্তন হবেই। তার প্রমাণ তিনি শেষ বয়সে ভাসান পানির আন্দোলন করে জেল খেটেছেন। তাই আসুন আজ তাঁর শববর্ষে এসে আমরা যদি ঐক্যবদ্ধভাবে মুক্তিযুদ্ধের মূল চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে বরুণদার নৈতিকতা ও আদর্শকে সমুন্নত রেখে কাজ করতে পারি, তবেই বাংলাদেশ বরুণদার স্বপ্নের বাংলাদেশে পরিণত হবে এবং মুক্তিযুদ্ধের মূল উদ্দেশ্য বাস্তবায়িত হবে।