শাল্লায় বাঁধ নির্মাণে দুর্নীতি-অনিয়ম

স্টাফ রিপোর্টার, শাল্লা
বাঁধ নির্মাণে নীতিমালার তোয়াক্কা না করে জমিহীন এক ইউনিয়নের লোককে অন্য ইউনিয়নের একটি হাওররক্ষা বাঁধের সামান্য কাজ করতে ২৫ লাখ টাকা বরাদ্দ দিয়েছেন পানি উন্নয়ন বোর্ড শাল্লার কর্তৃপক্ষ। যা উপজেলায় রীতিমতো চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়েছে। বাঁধের পাশের জমির স্থানীয় কৃষকের অধিকার কেড়ে নিয়ে কৃষক নয়, এমন লোকদের পিআইসি দেয়ায় এলাকার কৃষকের মাঝে ক্ষোভ বিরাজ করছে।
হবিবপুর ইউনিয়নের মৌরাপুর গ্রামের কৃষকরা বলেন, ২৭ নম্বর বাঁধটি পড়েছে হবিবপুর ইউপির মৌরাপুর গ্রাম সংলগ্ন ভান্ডাবিল হাওরে। ২৭ নম্বর পিআইসির সদস্য সচিব বকুল আহমেদ’র বাড়ি ২০ কিলোমিটার দূরে শাল্লা ইউপির দামপুর গ্রামে। প্রকল্পের সভাপতি শান্ত কুমার তালুকদারে বাড়ি নারকিলা গ্রামে। বাঁধ থেকে তার গ্রামের বাড়ি ৭ কি.মি. দূরে। প্রকল্পের সদস্য বিপ্লব রায় পিতা বরেন্দ্র রায় বাড়ি উপজেলার আনন্দপুর গ্রামে। বাঁধ থেকে প্রায় ১৫ কি.মি. দূরে। তাদের এক ইঞ্চি জমিও নেই বাঁধের আশেপাশে।
তারপরও কেন তাদের পিআইসি দেয়া হলো জানতে চাইলে এলাকাবাসী জানান, তারা ৩ জন নাকি সাংবাদিকও। যাতে তারা বাঁধের বিষয়ে কোন প্রকার লেখালিখি না করেন, সে জন্য প্রতি বছর এই বাঁধটি তাদের দেয় কর্তৃপক্ষ। আমরা প্রতিবাদ করলেও কাজের কাজ কিছুই হয় না। এদিকে কৃষক নয়, এমন ব্যক্তিদের যে বা যারা পিআইসি দিয়েছেন তাদের বিরুদ্ধে প্রশাসন তদন্তপূর্বক কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি জানিয়েছে হাওর বাঁচাও আন্দোলন উপজেলা কমিটি।
জানা যায়, সংবাদকর্মী ওই তিনজন অবস্থান করে শাল্লা সদরে। পেশায় শান্ত কুমার তালুকদার দলিল লেখক, বকুল আহমেদের রয়েছে চা-পান ও সিগারেটের দোকান, আর বিপ্লব রায়ের রয়েছে ফার্মেসী ব্যবসা।
উপজেলার ভান্ডাবিল হাওর উপ প্রকল্পের আওতায় ২৭ নম্বর পিআইসির বাঁধে কোনো সাইনবোর্ড পাওয়া যায় নি। তবে পানি উন্নয়ন বোর্ডের ওয়েবসাইটে দেখা যায়, ভান্ডাবিল হাওরের নতুন বৈশাখালি ভাঙা হতে ১৪৬ মিটার অক্ষত বাঁধে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে ২৪ লাখ ৯৭ হাজার ৮৩২ টাকা ৫৫ পয়সা।
মৌরাপুর গ্রামের সঞ্জয় চন্দ্র দাস বললেন, শান্ত দাসের বাড়ি নারকিলা, বকুল আহমেদের বাড়ি শাল্লা ইউপির দামপুর, বিপ্লব রায়ের বাড়ি আনন্দপুর গ্রামে। এই হাওরে এদের কোন জমি নাই। একেক জনের বাড়ি বাঁধ থাইক্কা ২৫ থেকে ৩০ কিলোমিটার দূরে। এরা সবাই থাকে ঘুঙ্গিয়ারগাঁও বাজারে। শুনছি ওরা নাকি সাংবাদিক। এদের বাঁধও টেকসই হয় নাই, কাজও বাকি আছে। এরা পিআাইসি পায় কীভাবে এমন প্রশ্ন তোলেন তিনি।
ভান্ডাবিল হাওরের ২৬ নম্বর পিআইসির সদস্য রবীন্দ্র চন্দ্র দাস বলেন, তারা যে পিআাইসি আনছে, তাদের তো একগুটা জমি নাই এই হাওরে। আমাদের ২৬ নম্বর পিআইসির মধ্যে একটু অংশে তাদের ঢুকাই দিছে। আমাদের ২৬ নম্বর পিআইসির ৭২৮ মিটার বাঁধে বরাদ্দ দিছে মাত্র ২০ লাখ ৫৪ হাজার টাকা, আর তাদের ১৪৬ মিটারে বরাদ্দ দিছে ২৫ লাখ টাকা। আমরা গরীব মানুষ কিছু মাছ টাস মাইরা খাই। এরার বিরুদ্ধে কিছু কইতে গেলেই পুলিশ পাঠাইয়া আমাদের হয়রানি করে। আমাদের অনেক ক্ষতি করছে এরা। মানুষ অখন ডরাইয়া এরার বিরুদ্ধে কিছু কইতো চায় না। বাঁধে মাত্র ৪ লাখ টাকার মাটি কাটছে বলে জানান তিনি।
একই গ্রামের অশুক চন্দ্র দাস বলেন, প্রতিবাদ করতে গিয়া চড় খাইতাম নি। এখন যদি পাইন্যে ঢেক্কা দেয় পইলা আমার ক্ষেত তলে যাইব। কইবার যায়গা নাই। কানবার জায়গা নাই আমরার। শান্ত দাসের বাঁধে ২৫ লাখ টাকা পাইছে। এরার ২/৪ লাখ টাকা খরচ অইব।
মৌরাপুর গ্রামের খোদ ২৭ নম্বর পিআইসির সদস্য সুজিত কুমার দাস বলেন, তাদের জমি নেই হাওরে। আমি আবেদনই করি নি। তারপরও তারা আমারে সদস্য রাখছে। এরা তো প্রতি বছরই পিআইসি নেয়। তিনি বলেন, বাঁধে ৭ লাখ টাকা খরচ হয়েছে।
অন্যদিকে (৮, ৯ ও ১০ মার্চ) ৩ দিন সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, বরাম হাওর উপ প্রকল্পের আওতায় ৫০, ৫১, ৫৬ ও ৫৭ নম্বর পিআইসির মাটির কাজ মাত্র শুরু হয়েছে। এলাকার কৃষকরা বলছেন, কাজ সম্পন্ন হতে সময় লাগবে আরও ১৫দিন।
শাল্লা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আবু তালেব বলেন, ৫১, ৫৭ প্রকল্প এলাকার উপর দিয়ে অন্য পিআাইসির গাড়ি চলার কারণে তারা কাজ শুরু করতে পারেন নাই। আমাদের ২টা পিআইসির মাটির কাজ বাকি আছে। অন্যান্য পিআইসির ড্রেসিংয়ের কাজ বাকি আছে।
কত পার্সেন্ট কাজ হয়েছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, এই মূহুর্তে আমি বলতে পারব না। তবে আজকে (শনিবার) সন্ধ্যায় পানি উন্নয়ন বোর্ডের ওয়েবসাইটে এই তথ্য দেবেন বলে জানান তিনি।
২৭ নং পিআইসির বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ওরা তো কম্পিউটারে কাজ করার সময় আমার সামনে কাগজপত্র দিছে। গত বছরও এরা কাজ করেছে। কাগজপত্র জমা দেওয়ার প্রেক্ষিতেই তাদের পিআাইসি দেওয়া হয়েছে। তাদের জমি নেই হাওওে, এমন অভিযোগ তার কাছে পৌঁছেনি বলে জানান তিনি।
প্রসঙ্গত, গত বছর শাল্লা উপজেলায় ১৩৮ বাঁধের বিপরীতে ২৪ কোটি টাকা বরাদ্দ ছিল। এবার ১৯৭টি পিআইসিতে প্রায় ৪২ কোটি টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়েছে।