শিক্ষকদের বিদ্যালয়ে অনুপস্থিতি/ দুর্গম হাওরাঞ্চলের শিক্ষাকে মানসম্মত করুন

গত ২৬ ফেব্রুয়ারি, রবিবার। সকাল তখন ১০ টা বেজে ২ মিনিট। উপজেলা নির্বাহী অফিসার, তাহিরপুর গেছেন মাটিয়ান হাওরের বিভিন্ন বাঁধের কাজ দেখতে। পথিমধ্যে পেয়ে গেলেন একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়। মাটিয়ান সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় এর নাম। তিনি ঢুকে গেলেন ওই বিদ্যালয় আঙ্গিনায়। সবিস্ময়ে দেখতে পেলেন বিদ্যালয়ের সবগুলো কক্ষ তখনও তালাবদ্ধ। কোনো শিক্ষক আসেননি। কিন্তু বিদ্যালয়ে জমায়েত হয়ে গেছে শিক্ষার্থীদের। উপজেলা নির্বাহী অফিসার শিক্ষার্থীদের সাথে কিছু সময় কাটান। তিনি যতক্ষণ ওই বিদ্যালয়ে অবস্থান করছিলেন ততক্ষণ পর্যন্ত কোনো শিক্ষকেরই পদধূলি পড়েনি শিক্ষায়তনটিতে। ক্ষুব্ধ নির্বাহী অফিসার অনুপস্থিত শিক্ষকদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তাকে তাৎক্ষণিক নির্দেশ দেন। ভাত ফুটেছে কিনা তা দেখতে ডেগের সব ভাত টিপে দেখার দরকার হয় না। একটি ভাত টিপলেই ডেগের অবস্থা বুঝা যায়। আলোচ্য ঘটনাটিও তদনুরূপ। হাওরাঞ্চলের শিক্ষা ব্যবস্থার হাল-হকিকত বুঝার জন্য এই একটি ঘটনাই যথেষ্ট। হাওরাঞ্চল দুর্গম। সহজ যাতায়াত ব্যবস্থা নেই। ফলে কর্তৃপক্ষের নিয়মিত নজরদারিতে থাকে না এসব বিদ্যালয়। এর সুযোগ নেন সরকারি বেতনভোগী শিক্ষকরা। যে যেরকম ইচ্ছা বিদ্যালয়ে যান। একইভাবে যখন খুশি তখন বিদ্যালয় ছুটি দিয়ে চলে আসেন। বিদ্যালয়ের শ্রেণি কার্যক্রম এসব বিদ্যালয়ে চালু থাকে খুবই অল্প সময়। নানা সময়ে এসব বিষয় নিয়ে সংবাদমাধ্যমে খবর হয়েছে। কিন্তু অবস্থার তেমন ইতিবাচক পরিবর্তন ঘটেনি। ফলে পুরো হাওর অঞ্চলে শিক্ষার গুণগত ও পরিমাণগত অগ্রগতির বিষয়টি এখনও অধরাই থেকে গেছে।
ওই বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক নিজের অনুপস্থিতি সম্পর্কে একটি খোঁড়া যুক্তি তোলে ধরেছেন। তিনি নাকি ওইদিন হাসপাতালে যাওয়ার অনুমতি নিয়েছিলেন কর্তৃপক্ষের নিকট থেকে। দোষ চাপালেন সহকারি শিক্ষকদের উপর। তিনি বলেছেন, সহকারী শিক্ষকরা যথাসময়ে বিদ্যালয়ে গমন না করার কারণেই ঘটেছে এই বিপত্তি। প্রধান শিক্ষক সহকারীদের উপর দোষ চাপালেও প্রকৃত কারণটি কারও অজানা নয়। এ কারণ হলো দেরিতে বিদ্যালয়ে গমন ও সময়ের আগে বিদ্যালয় পরিত্যাগের সংস্কৃতি। এই সংস্কৃতি তাঁরা তৈরি করেছেন। শিক্ষার্থী ও স্থানীয় অভিভাবকদের বক্তব্য নিলে এমন সত্যই বেরিয়ে আসবে। দুর্গম হাওরাঞ্চলের বিদ্যালয়গুলোর এমন করুণ অবস্থার অবসান কাম্য। এজন্য তদারকি ব্যবস্থার উন্নয়ন ঘটানো উচিৎ। প্রযুক্তির কলাণে এখন আর তদারকি করা কঠিন কোনো কাজ নয়। কিছু বিদ্যালয়ে নেটওয়ার্ক সংযুক্তি আছে। শিক্ষকদের হাতে আছে মুঠোফোন। সুতরাং তদারকি কর্তৃপক্ষ ইচ্ছা করলে সহজেই শিক্ষকদের গতিবিধি পর্যবেক্ষণে রাখতে পারেন। এ কথাও ঠিক শিক্ষকদের অবস্থানস্থল থেকে বিদ্যালয়ে যাওয়া বেশ কষ্টসাধ্য। সময়মত যানবাহনের ব্যবস্থা থাকে না। কিন্তু যাতায়াত সংকটের কারণে বিদ্যালয়ে সময়মত উপস্থিত না হতে পারা কোনো অবস্থাতেই গ্রহণযোগ্য নয়। সময়মত বিদ্যালয়ে পৌঁছানোর জন্য বিকল্প যাতায়াত ব্যবস্থা শিক্ষকদেরই নিশ্চিত করতে হবে। সরকার নির্ধারিত সময়সূচি অনুসারে বিদ্যালয়ের শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা করা সরকারি কর্মচারী হিসাবে শিক্ষকদের অপরিহার্য কর্তব্য বটে। এই জায়গায় কোনো বিচ্যুতি কর্তব্যে অবহেলা ও অদক্ষতা হিসাবে বিবেচনাযোগ্য।
করোনার কারণে অন্তত দুই বছর আমাদের বিদ্যালয়গুলোতে শ্রেণি কার্যক্রম পুরোপুরি বন্ধ ছিল। এ কারণে গ্রামাঞ্চলের শিক্ষার্থীদের শিখন কার্যক্রমে বড় ঘাটতি তৈরি হয়েছে। এই ঘাটতি দূর করতে এখন সবিশেষ তৎপরতা কাম্য। শিক্ষকরা আন্তরিক ও অভিভাবকরা কর্তব্য সচেতন হলে শিশু শিক্ষার্থীরা ওই ঘাটতি পুষিয়ে উঠার সুযোগ পাবে। নতুবা শিক্ষার্থীদের পুরো জীবনই এই ঘাটতি নিয়ে চলতে হবে। তাহিরপুরসহ জেলার সকল বিদ্যালয় বিশেষ করে দুর্গম হাওরাঞ্চলের বিদ্যালয়গুলোর শিক্ষকদের নিকট আমাদের একান্ত অনুরোধ, ভবিষ্যৎ প্রজন্ম এই শিশু শিক্ষার্থীদের শিখন দক্ষতা অর্জনের জন্য নিজের কর্তব্যনিষ্ঠা দিয়ে জাতির কারিগর হিসাবে যথোপযুক্ত ভূমিকা পালন করুন।