সতর্ক হোন, শিক্ষা নিন

তুরস্ক ও সিরিয়ায় উচ্চমাত্রার ভূমিকম্পে ব্যাপক প্রাণহানির প্রেক্ষাপটে এখন সেখানকার ভবন নির্মাণে জড়িত ঠিকাদার ও ডেভালাপার কোম্পানির মালিকদের বিরুদ্ধে গ্রেফতার অভিযান শুরু করা হয়েছে। অনেক ডেভালাপার ও ঠিকাদার দেশ থেকে পালিয়ে গেছেন। অনেক পালানোর সময় ধরা পড়েছেন। ইতোমধ্যে ১১৩ জনের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি হয়েছে। শতাধিক ব্যক্তিকে গ্রেফতারও করা হয়েছে। প্রলয়ংকরী ভূমিকম্পে তুরস্ক ও সিরিয়ায় ৩৩ হাজারের বেশি মৃত্যুর খবর মিলেছে রবিবার পর্যন্ত। জাতিসংঘের আশঙ্কা মৃত্যুসংখ্যা এর দ্বিগুণ হতে পারে। তুরস্কবাসী মনে করেন ভবন নির্মাণে ত্রুটি, বিল্ডিংকোড না মানা এবং বেশি মুনাফা করার জন্য দুর্বল নির্মাণ কাজের কারণেই অধিকাংশ ভবন ধসেছে। কেবল তুরস্কেই ৬ হাজারের বেশি ভবন ধসেছে।
প্রাকৃতিক দুর্যোগের উপর মানুষের হাত নেই। কিন্তু যখন এতে মানুষের সীমাহীন লোভ, মাত্রাছাড়া দুর্নীতি, অবহেলা ও অমানবিকতার সম্পর্ক পাওয়া যায় তখন তাকে কেবল প্রাকৃতিক দুর্যোগ হিসাবে মানার অবকাশ থাকে না। এখন বড় বড় ভবন নির্মাণ করা হয় ভূমিকম্প ঝুঁকি মাথায় রেখে। তুরস্ক বড় ধরনের ভূমিকম্পপ্রবণ এলাকা। দুই দশক আগেও সেখানে বড় ধরনের ভূমিকম্পে ১৭ হাজার মানুষ মৃত্যুবরণ করেছিলেন। সুতরাং তুরস্কে ভবনের নকশায় অবধারিতভাবেই এই ঝুঁকিকে মোকাবিলা করার মতো প্রাযুক্তিক বিষয় সংযুক্ত থাকে। কিন্তু অবাক বিষ্ময়ে লক্ষ্য করা গেল কোনো ভবনই ভূমিকম্পের আঘাত থেকে রক্ষা পেতে পারেনি। হুড়মুড় করে ভেঙে পড়েছে ১৪ তলা, ১৬ তলা ভবনগুলো। তুরস্কের জনগণ অভিযোগ করেছেন দুনীতিবাজ নির্মাণ ব্যবসায়ীরা অতীতে এরকম অসততা করলেও তারা সরকারের সাধারণ ক্ষমা পেয়েছেন। তাই এরা ক্রমশ বেপরোয়া হয়ে উঠেছিলেন। তুরস্ক সরকার এখন যে ব্যবস্থা নিচ্ছে তা কেবলমাত্র আইওয়াশ কিনা তা বুঝতে অপেক্ষা করতে হবে। তবে ব্যাপক জনবিক্ষোভ প্রশমিত করতে দেশে দেশে শাসকগোষ্ঠী এরকম আইওয়াশ করে থাকে। বিক্ষোভের প্রাথমিক ধাক্কা সামলানোর পর আবার পূর্বাবস্থা ফিরে আসে। এ থেকে তুরস্কের ক্ষমতাসীনদের দুর্নীতিগ্রস্ত চেহারাটি সামনে আসে। সামনে সে দেশের জাতীয় নির্বাচন। ওই নির্বাচনে ডানপন্থী এরদোয়ান সরকার নিজেদের দুর্নীতিকে আড়াল করতে এ ধরনের নানা কাজ করতে থাকবে। কিন্তু যে লোকগুলো প্রাণ ও সম্পদ হারিয়েছে এতে তাদের কিছুই আসে যাবে না। সর্বহারাদের লাশের স্তূপের উপর দাঁড়িয়ে পুনরায় ক্ষমতায় আসার হীন প্রবৃত্তিকে আটকানোর সাধ্য কারও নেই। পৃথিবীর নানা দেশে এরকমটি দেখে আমরা অভ্যস্ত।
তবে ভবন নির্মাণের ঠিকাদার ও ডেভালাপারদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের এই ্উদাহরণ থেকে আমাদের দেশের সতর্ক হওয়া প্রয়োজন। আমাদের দেশেও বহুতল ভবন নির্মাণ করতে কেউ কোনো নিয়ম মানে না। তুরস্কের মতো এ দেশেও অসৎ ব্যবসায়ী ও ঠিকাদাররা নির্মাণ কাজে কম খরচ করার জন্য তথা মুনাফা বাড়াতে কাজের সঠিক মান বজায় রাখে না। নির্মাণের পরপরই সেতু, ভবন ও সড়ক ধসে পড়ার খবর নিয়মিতই পাওয়া যায়। আমাদের দেশও ভূমিকম্প ঝুঁকির দেশ। বিশেষজ্ঞরা বলছেন যেকোনো সময় বড় মাত্রার ভূমিকম্প আঘাত করতে পারে। যদি এরকম হয় তাহলে ক্ষতির মাত্রা কল্পনাও করা যাবে না। তাই সকলেই নির্মাণ কাজে নিয়ম মানার উপর ক্রমাগত তাগিদ দিচ্ছেন। এ দেশে যারা রিয়েল এস্টেট ব্যবসা করেন, বা সরকারি-বেসরকারি অবকাঠামো নির্মাণের ঠিকাদারি করেন; তাদেরকে তুরস্কের নির্মম উদাহরণ থেকে শিক্ষা নিতে হবে। শিক্ষা নিতে হবে সরকার ও এতদসংক্রান্ত সকল সরকারি কর্তৃপক্ষকে। ঘটনা ঘটিবার পর হায়-আফসোস করা নয় ঘটনা ঘটার আগে যথেষ্ট সতর্কতা অবলম্বন করার মতো বুদ্ধিমান হতে হবে সকলকে। অন্তত তুরস্ক-সিরিয়ার ভয়াবহ মানবিক বিপর্যয় থেকে আমাদের এটুকো শিক্ষা গ্রহণ করা উচিত।