বিশেষ প্রতিনিধি
ফসল রক্ষা বাঁধের কাজের বর্ধিত সময়ের আর মাত্র দুই দিন বাকি। শেষপর্যায়ে এসেও বাঁধের অনেক কাজ বাকি রয়ে গেছে। দুুর্বা-দুরমুশ, প্যালাসেটিং দূরের কথা, এখনও মাটি ফেলার কাজই শেষ হয়নি কোন কোন বাঁধে। ঝুঁকিপূর্ণ ক্লোজারও রয়েছে অরক্ষিত অবস্থায়। যেখানে উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ সহজে পৌঁছাতে পারছেন, সেখানে কাজের গতি একধরণের, প্রত্যন্ত হাওররক্ষা বাঁধে আরেক অবস্থা। এখন পর্যন্ত বাঁধের কাজ যতটুকু এগিয়েছে তাতে পানি উন্নয়ন বোর্ডের গড় হিসাব ৮৭ শতাংশ। বাস্তবে সেটি আরও অনেক কম। পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ের সচিব শনিবার সুনামগঞ্জের হাওর রক্ষা বাঁধের নির্মাণ কাজ ঘুরে দেখার সময় বলেছেন, ফসল রক্ষা বাঁধের কাজে অনিয়ম করলে, তাকে আইনের আওতায় আনা হবে।
জেলার দিরাই উপজেলার উজান ধলের পাশের তুফানখালি বাঁধে শুক্রবার বিকালে গিয়ে দেখা গেছে, গুরুত্বপূর্ণ বাঁধটির ক্লোজার অংশ এখনো অরক্ষিত। বাঁধের দুইপাশে কাজ করে মাঝখানে একটি এক্সকেভেটর দিয়ে শেষ সময়ে নরম কাদা মাটি তোলা হচ্ছে। মাটির কমপেকশনের জন্য কোন কাজ হচ্ছে না।
বাঁধের পাশে দাঁড়ানো ধল আশ্রম গ্রামের কৃষক রূপন মিয়া বললেন, ‘কালনী নদীতে গোলা (জোয়ার) আসার সময় এসেছে। এখন এক্সকেভেটর দিয়ে মাটি তুলে বাঁধের দায় সারার কাজ হচ্ছে, কমপেকসন, দুরমুশ কিছুই হচ্ছে না, বাঁধের বুরঙ্গা দিয়ে হাওর ডুবলে কেবল দিরাই-শাল্লার মানুষ নয়, নেত্রকোণা-কিশোরগঞ্জে গিয়ে পানি ঠেকবে।’
পাশে দাঁড়ানো কৃষক আঙ্গুর মিয়া বললেন, অসময়ে দেওয়া দুর্বল বাঁধ পানির বড় ধাক্কা সামলাতে পারবে না। বাঁধের মাটির কমপেকশন হবার আগেই বৃষ্টিপাত শুরু হবে। বাঁধ তখন ধসে পড়ার বা ভাঙার আশংকা থাকবে।’ তিনি জানান, কালনী নদীর কূল ঘেষে বিশাল বরাম হাওরে পানি ঢুকার সবচেয়ে বড় ক্লোজার এটি (তুফানখালি), ২০১৭ সালে এই বাঁধে ভেঙে পাশের বরাম হাওর, শাল্লার ছায়ার হাওর ডুবিয়ে কিশোরগঞ্জের মিঠামইন অষ্টগ্রাম এবং নেত্রকোণার ছোটখাটো অনেক হাওর ডুবে যায়।
এরকম একটি গুরুত্বপূর্ণ বাঁধ করতে এভাবে অবহেলা কেন হলো জানতে চাইলে, দিরাই উপজেলা হাওর রক্ষা বাঁধ নির্মাণ ও মনিটরিং কমিটির সদস্য সচিব পাউবো প্রকৌশলী আব্দুল মোনায়েম বললেন, বাঁধের বাম ডানের দুই পাশের কাজ করা হয়েছে মাঝখান দিয়ে মাটি তুলে, পরে এই অংশে যখন কাজ ধরানো হয়, তখন এক্সকেভেটর মেশিন বার বার নষ্ট হওয়ায় এখানে কাজ শুরু করতে বিলম্ব হয়েছে। তিনি অবশ্য আগামী দুই দিনের মধ্যে বাঁধের কাজ শেষ করে প্যালাসেটিং বিছানোর কাজও শেষ করতে পারবেন এমন দাবি করলেন।
প্রকৌশলী মোনায়েমের কথার সঙ্গে মিললো না এই বাঁধের অর্থাৎ ১৩৮ নম্বর প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটির (পিআইসি) সভাপতি আব্দুল হালিমের এই বিষয়ে দেওয়া বক্তব্য। তিনি বললেন, প্রথম দিকে এক্সকেভেটর মেলানো যায় নি। এখন যেহেতু কাজ শুরু করেছি, শেষ হয়ে যাবে। শুক্রবার রাতেও কাজ হয়েছে জানিয়ে বললেন, আগামী দুই দিনের বাঁধের কাজ শেষ হবে।
কথা বলার সময় বাঁধের পাশে থাকা কৃষকরা জানালেন, ২০১৭ সালে যারা অনিয়মের দায়ে দুদকের মামলার আসামী ছিল, তারাই নামে বেনামে এবারও বাঁধের কাজ করেছে।
সুনামগঞ্জে এবার ২০৩ কোটি টাকা ব্যয়ে ১০৭৮ টি পিআইসির মাধ্যমে ৭৩৫ কিলোমিটার বাঁধের কাজ হচ্ছে। এই পর্যন্ত বরাদ্দ পাওয়া গেছে ১০০ কোটি টাকা। নীতিমালা অনুযায়ী ১৫ ডিসেম্বরের মধ্যে শুরু হওয়া কাজ শেষ হবার নির্দেশনা আছে ২৮ ফেব্রুয়ারিতে। গেল ১৫ ফেব্রুয়ারি পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ের উপমন্ত্রী একেএম এনামুল হক শামীম কাজের অগ্রগতি দেখে মেয়াদ বর্ধিত করে ২৮ ফেব্রুয়ারি’র স্থলে সাত মার্চ পর্যন্ত বর্ধিত করেন।
কিন্তু শনিবার (চার মার্চ) পর্যন্ত ধর্মপাশার গাগলাখালি, শয়তানখালি, মধ্যনগরের আবিদনগর বাজার সংলগ্ন বাঁধ, জিনাইরা বাঁধ, তাহিরপুরের মহালিয়া হাওরের ১৯ ও ১৪ নম্বর প্রকল্প, মাটিয়ান হাওরের বনোয়া বাঁধ, জামালগঞ্জের হালির হাওরের পুরাতন গনিয়াখাড়া, দোয়ারাবাজারের নাইন্দার হাওরের দুই, ২৮ ও ৩৫ নম্বর প্রকল্পের কাজ শেষ হয় নি। শাল্লায় ভান্ডা বিল হাওরের ৩৪ ও ভেড়া মোহনার দুটি গুরুত্বপূর্ণ বাঁধ এবং জগন্নাথপুরের নলুয়ার হাওরের এক, নয়, ১০, ১১, ১৪ ও ১৮ নম্বর পিআইসির কাজ শেষ হয় নি।
বেশির ভাগ বাঁধ শক্তিশালী করতে বাঁশের আড় ও বস্তা দেওয়ার কোন আলামত চোখে পড়ে নি দিরাইয়ে।
এই উপজেলায় সরেজমিনে ঘুরে দেখা গেছে, কোন কোন হাওরে মাটির কাজ শেষ হলেও বাঁধ টেকসইয়ে ঘাষ-দুরমুশের কাজ অবশিষ্ট আছে।
হাওরের কৃষি ও কৃষক রক্ষা সংগ্রাম পরিষদের সদস্য সচিব চিত্ত রঞ্জন তালুকদার বললেন, জেলাজুড়েই এমন অবস্থা। অনেক বাঁধেই দায়সারা ভাবে মাটি ফেলে ঘাস লাগানোর কাজ শেষ না করেই প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটি বাঁধে ছেড়ে চলে এসেছে।
জেলা হাওর রক্ষা বাঁধ নির্মাণ ও মনিটরিং কমিটির সভাপতি জেলা প্রশাসক দিদারে আলম মোহাম্মদ মাকসুদ চৌধুরী বলেছেন, হাওর রক্ষা বাঁধের কাজ শেষ পর্যায়ে, কিছু কাজ বাকী আছে, আগামী দুই দিনের মধ্যে কাজ শেষ না করতে পারলে সংশ্লিষ্ট পিআইসি’র বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
এদিকে, শনিবার পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ের সচিব নাজমুল আহসান বিশ^ম্ভরপুরের কয়েকটি হাওর রক্ষা বাঁধ ঘুরে দেখার সময় বলেছেন, বাঁধের কাজে অনিয়ম কিংবা দুর্নীতি হলে জড়িতদের আইনের আওতায় আনা হবে। তিনি জানান, পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ের উপ-সচিব ও সিনিয়র সহকারী সচিবদের দিয়ে নয় সদস্যের তিনটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। তারা ফসল রক্ষা বাঁধের কাজের অগ্রগতি সার্বক্ষণিক নজরদারী করছেন।
- মধ্যনগরে সেচ দিয়ে মাছ শিকারের অভিযোগে জরিমানা
- ধর্মপাশায় বাঁধ পরিদর্শনে অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক