বিশেষ প্রতিনিধি
ফলন ভালো হলে হাওরের জেলা সুনামগঞ্জে বছরে ১২ থেকে ১৩ লাখ টন ধানের উৎপাদন হয়। কিন্তু এই জেলায় গেল সাত বছরেও সরকার এক লাখ টন ধান কেনেনি। সরকার ধান বেশি কিনলেই কৃষকরা ধানের ন্যায্যমূল্য পাওয়া নিশ্চিত হয়। ধান বেশি কেনার কৃষকদের দাবি আমলে নিচ্ছে না সরকার। এই অঞ্চলের কৃষক সংগঠকদের বহুদিনের দাবি জেলার মধ্যবর্তী অঞ্চলে কমপক্ষে তিনটি স্থানে ধান সংরক্ষণ সাইলো করলেই ধানের ন্যায্যমূল্য পাবেন প্রান্তিক কৃষকরা।
সরকার গেল বছর দেশের ৩০ টি জেলায় সাইলো করার পরিকল্পনা করলেও এই প্রকল্পের কোন অগ্রগতি নেই।
সুনামগঞ্জ খাদ্য বিভাগের একজন কর্মকর্তা জানান, জেলার ৩৮ টি সরকারি খাদ্য গোদামে ধান সংরক্ষণ করার ক্ষমতা মাত্র ২৪ হাজার ৪০০ টন। এরমধ্যে চাল, গমও সংরক্ষণ করা হয় এসব গোদামে।
বছরে লাখ লাখ টন ধানের উৎপাদন হলেও সরকারিভাবে গেল সাত বছরে সর্বোচ্চ একবার ৪০ হাজার ৮৫৭ টন ধানও কেনার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ হয়েছিল। অন্যান্য বছর আরও হম কেনা হয়েছে ধান।
খাদ্যবিভাগের দায়িত্বশীলদের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী ২০১৭ সালে ফসল তলিয়ে যাওয়ায় কোন ধান কেনা হয় নি। চাল কেনা হয়েছিল আতব তিন হাজার ৭৯৫ টন এবং সিদ্ধ ৫৫৮ টন। ২০১৮ সালে ধান ছয় হাজার ৮৫৭ টন, আতব চাল ১৫ হাজার ৭৮০ টন এবং সিদ্ধ পাঁচ হাজার ৩৯৯ টন। ২০১৯ সালে ধান ১৭ হাজার ৮২৩ টন, আতব ১৭ হাজার ৭৯৪ এবং সিদ্ধ ১৮ হাজার ৭২৬ টন। ২০২০ সালে ধান ২৫ হাজার ৩১৫ টন, আতব ১৬ হাজার ৬২০ এবং সিদ্ধ চার হাজার ৫০৮ টন। এই বছরে অবশ্য ধান কেনার লক্ষ্যমাত্র ছিল ৪০ হাজার ৮৫৭ টন এবং চাল আতব ১৮ হাজার ৬৩৪ এবং সিদ্ধ ছিল ১৫ হাজার ৩১১ টন। ২০২১ সালে ধান কেনার লক্ষ্যমাত্রা ছিল ২৭ হাজার ৬৩২ টন, আতব ১৭ হাজার ৪১ এবং সিদ্ধ কেনার লক্ষ্যমাত্রা ছিল ১৫ হাজার ৯৯৬ টন। খাদ্য বিভাগ কিনেছিল ধান ১৭ হাজার ৪১ টন। আতব ১০ হাজার ৭২৬ এবং সিদ্ধ ১১ হাজার ৭২৯ টন। ২০২২ সালে ধান কেনার লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৩২ হাজার ৫৭২ টন, ধান কেনা হয়েছে বিশ হাজার ৪০১ টন, আতব কেনা হয়েছে ১০ হাজার ৯৪১ এবং সিদ্ধ ১১ হাজার ৭২৮ টন। ২০২৩ সালে এ কারণে ধান কেনার লক্ষ্যমাত্র কমিয়ে ২১ হাজার ৩২৬ টন এবং সিদ্ধ চাল কেনা হবে ১২ হাজার ২৮০ টন। খাদ্য বিভাগের দায়িত্বশীলরা জানান, কেনা বেচার শুরুর দিকে মাত্র ৬১২ টন ধান কেনা হয়েছে। সিদ্ধ চাল ১২ হাজার ২৮০ টনের লক্ষ্যমাত্রার মধ্যে তিন হাজার ১৯০ টন কেনা হয়েছে।
খাদ্য বিভাগের সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা দাবি করেছেন, সরকার ১২ শ টাকা মণ ধানের মূল্যে নির্ধারণের ফলেই ধানের বাজার দর প্রতিমণ হাজারের উপরে ওঠেছে। তবে ধান কেনা বিলম্বে শুরু হওয়ায় শুরু’র দিকে সরকারি গোদামে ধান নিয়ে যেতে পারে নি কৃষকরা।
শাল্লার বড় কৃষক ছাত্তার মিয়া বললেন, শুরুর দিকেই ধান কিনতে হবে সরকারকে। ওই সময়ে কৃষকরা ধান গোদামে নিয়ে গেলে কম শুকানো, চাটা বা চোচার কথা ওঠানো হয়, এছাড়া ধানও পরিমাণে কম কেনা হয়। সব মিলিয়ে এবারও কৃষকরা বাজারেই ধান বিক্রি করতে স্বস্তি বোধ করছেন। তার মতে ভাটি এলাকায় ধানের সাইলো হলে শুকনা-ভেজা’র প্রশ্নও আসতো না। বেশি পরিমাণে ধানও বিক্রয় করা যেত সাইলোতে।
তিনি জানালেন, শাল্লায় ধানের উৎপাদন লাখ টন ছাড়িয়ে যায়। অথচ. এখানে ধান সংরক্ষণের সরকারি গোদাম মাত্র একটি, এটির ধারণ ক্ষমতা ৫০০ টন। তাহলে সরকার ধানের কেনার লক্ষ্যমাত্রা বাড়াবে কীভাবে, রাখবেই বা কোথায়।
জেলা সিপিবির সভাপতি অ্যাডভোকেট এনাম আহমদ বললেন, কৃষকদের উৎপাদিত ধানের ন্যায্যমূল্য পাওয়ার জন্য জেলায় অন্তত. তিনটি স্থানে এক থেকে দেড়শ টন ধারণ ক্ষমতা সম্পন্ন ধানের সাইলো নির্মাণ জরুরি। যেগুলোতে ধান ঝাড়াই, বাছাই, শুকানো, আদ্রতা নিয়ন্ত্রক ব্যবস্থা ও আনুষঙ্গিক সুবিধাদি থাকবে। সাইলো হলে কৃষকরা বেশি ধান দিতে পারবেন। শুকানো ও আদ্রতা নিয়েও দুশ্চিন্তা থাকবে না। সরকার সাইলোও করতে পারছে না। ধানও সঠিক সময়ে বিপূল পরিমাণে কিনতে না পারায় কৃষকরা ন্যায্য দাম পাচ্ছে না।
কৃষক সমিতির কেন্দ্রীয় নেতা ধর্মপাশার বাদশাগঞ্জের বাসিন্দা খায়রুল বাশার ঠাকুর খান বললেন, সারসহ কৃষি উপকরণের মূল্য বৃদ্ধির যে চাপ কৃষকের উপর পড়েছে, তাতে চাষাবাদে উৎসাহ হারাচ্ছেন ভাটি অঞ্চলের কৃষকরা। এরমধ্যে উৎপাদিত পণ্যের বিক্রয়ের সময় নানা রকমের হয়রানি। সরকার কৃষকের কাছ থেকে সরাসরি ধান কিনতে ধানের সংরক্ষণ সাইলো করার কথা শুনা গেল, সেটাও হচ্ছে না। ধানের দামের ন্যায্যতা নিশ্চিতের জন্য একাধিক ধান সংরক্ষণ সাইলো হতে পারে বোর ধান নির্ভর এলাকায়।
সংরক্ষিত নারী আসনের সংসদ সদস্য কৃষক লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক শামীমা আক্তার খানম বললেন, দুই বছর আগেই জেলার মধ্যবর্তী উপজেলা জামালগঞ্জে ধানের সাইলো করার জন্য সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে ডিও লেটার দিয়েছি। ওখানে বিনামূল্যে জমি দিতেও প্রস্তুত আছেন স্থানীয়রা। জামালগঞ্জে সাইলো হলে আশপাশের উপজেলা থেকে নৌ এবং সড়কপথে দুইভাবেই ধান নিয়ে আসতে পারবেন কৃষকরা। আশাকরছি ওখানেই ধান সংরক্ষণ সাইলো হবে। জেলার অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ চাষাবাদ এলাকায় হতে পারে। এই বিষয়ে আবারও যোগাযোগ করবো মন্ত্রণালয়ে।
জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক মোহাম্মদ মঈনুল ইসলাম ভূঞা বললেন, সরকার দেশের ৩০ টি কৃষি প্রধান অঞ্চলে ধানের সাইলো করার উদ্যোগ নিয়েছিলেন। করোনাসহ বিভিন্ন দুর্যোগের কারণে সেই উদ্যোগ বাস্তবায়ন দ্রুততার সঙ্গে হয় নি। আশা করছি সেটি হবে এবং কৃষকরা তাদের উৎপাদিত ধান সহজেই ন্যায্য দামে বিক্রয় করতে পারবেন। তখন ভেজা-শুকনা, আদ্রতা কম এসব খোঁজা হবে না।
- ৪০দিন নামাজ পড়ে বাইসাইকেল পেল ৬ শিশু
- ছাতকে বোরো ধান সংগ্রহ শুরু