ব্রজেন্দ্র কুমার দাস
জন্ম আমার সুনামগঞ্জ জেলার দিরাই থানার শ্যামারচর গ্রামে। আমার জীবনের প্রথম দেখা শহর সুনামগঞ্জ। সুনামগঞ্জের মাটির সাথে আমার আত্মিক সম্পর্ক। সে সম্পর্ক কিছুতেই ছিন্ন করার নয়। তাই সুনামগঞ্জ আমার প্রাণের শহর। আমার জীবনে প্রথম বাস দেখেছি সুনামগঞ্জে আসার পথে। প্রথমে নৌকায় সুনামগঞ্জে আসতে হতো। জয়কলসে এসে যখন বাসে সুনামগঞ্জ আসি তখন সেকি শিহরণ। শ্যামারচর প্রাইমারী স্কুল থেকে বৃত্তি পরীক্ষা দেবার জন্য আমার প্রথম সুনামগঞ্জে আসা। বাড়ী থেকে নদীপথে সুনামগঞ্জে আসি। নৌকায় থেকেই পরীক্ষা দেই। মনে পড়ে সুনামগঞ্জ সরকারী জুবিলী স্কুলের মাঠের কাছে নদীতে নৌকা রাখা হয়। বুলচান্দ স্কুলে পরীক্ষার সিট। মনে পড়ে সে সময়ই সুনামগঞ্জ শহরের ছেলে আজকের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ বন্ধুবর শ্রী পরিমল কান্তি দে মহাশয়ের সাথে আমার প্রথম দেখা। আমি নিরেট গ্রামের ছেলে, শহরের এক ছাত্রের সাথে পরিচয় হওয়া সেটা কি চাট্টিখানি কথা ! ওনার মনে আছে কি না জানি না কিন্তু আমি সে স্মৃতি আজো ভুলতে পারিনি। পরীক্ষা শেষে নৌকায় আসার পথে সরকারী জুবিলী স্কুলের সামনে আসতেই দেখলাম হু হু করে কি যেন একটা চলে যাচ্ছে। আমি অপলক দৃষ্টিতে সেটা দেখতে লাগলাম যতক্ষণ তা দেখা যায়। আমার স্যারের কাছে জানতে চেয়েছিলাম ওটা কি, তিনি বলেছিলেন, ওটা মোটরসাইকেল। সেই প্রথম আমার মোটরসাইকেল দর্শন। এমনি কতো স্মৃতি সুনামগঞ্জকে ঘিরে তা যেন বলে শেষ করার নয়।
চাকরী সূত্রে সিলেট থেকে অবসর নেয়ার কারণে সিলেটেই থাকতে হলো। গ্রামের ছেলে সেই আর এক গ্রামেই বসবাস। সিলেটের বটেশ্বর এলাকার গ্রাম জালালনগরে আজ বসবাস। সেই গ্রাম এলাকাতেই সৌভাগ্যক্রমে পেয়ে গেলাম এক বীর মুক্তিযোদ্ধা বাবরুল হোসেন বাবলু সাহেবকে। উনার বাসস্থান অনেকটা কাছেই। সে সুবাদে ওনার সাথে মাঝে মাঝে দেখা হয়। হয় নানা আলাপ। আলোচনা। অনেক স্মৃতি রোমন্থন। একদিন সকালে হাঁটতে হাঁটতে কথা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘আপনার বাড়ী তো সুনামগঞ্জে। আপনি কি বলতে পারেন সুনামগঞ্জের প্রথম মন্ত্রী কে ছিলেন? আমি ভীষণ বিব্রত বোধ করলাম। সুনামগঞ্জের মাটিতে জন্ম নেয়া অনেক মন্ত্রী মহোদয়গণের নাম জানি কিন্তু সুনামগঞ্জের প্রথম মন্ত্রী কে ছিলেন তা তো জানি না। ভদ্রলোক আমার অসহায়ত্ব বুঝতে পেরে মৃদু হেসে বললেন, ‘ঠিক আছে, আমি আপনাকে একটা বই দেবো, তাতেই পাবেন কে সুনামগঞ্জের প্রথম মন্ত্রী।’ পরদিন ভদ্রলোক আমাকে ‘এক আলোকিত ব্যক্তিত্ব : মুনাওওয়ার আলী’ নামে একটি বই দিয়ে গেলেন। বইটি মনোযোগ সহকারে পড়লাম। গুণীজনের অনেক নিবন্ধে অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য জানা যায়।
প্রফেসর ড: আনিসুজ্জামান এর ‘বিস্মৃতপ্রায় মনীষী মুনাওওয়ার আলী’ নিবন্ধ থেকে জানা যায় প্রয়াত জনাব মুনাওওয়ার আলী চারবার অবিভক্ত আসামের মন্ত্রী ছিলেন। তিনি শিক্ষা, কৃষি, বন, আবগারি ও জেল মন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেছেন। তিনি ১৯০৭ সালে বিএ পাশ করেন এবং ১৯০৯ সালে ল’ডিগ্রি অর্জন করেন। জনাব হাসান শাহরিয়ার, এক্সিকিউটিভ এডিটর দৈনিক ইত্তেফাক, সংবাদদাদা নিউজ উইক, ইউএসএ ডেকান হেরাল্ড ইন্ডিয়া, সভাপতি কমনওয়েথ জার্নালিস্ট এসোসিয়েশন” তার আসাম আইনসভায় ‘মিনিস্টার বাড়ির প্রবাদপুরুষ মুনাওওর আলী নিবন্ধে উল্লেখ করা হয় জনাব মুনাওওর আলী ই হলেন সুনামগঞ্জের প্রথম মন্ত্রী।
সুনামগঞ্জের প্রবীণ বাজনীতিবিদ সাবেক ছাত্রনেতা ও সাবেক সংসদ সদস্য মো. আব্দুজ জহুর তাঁর স্মৃতিচারণ মূলক নিবন্ধ ‘আমার দেখা মুনাওওর আলী’ -এ লিখেন ‘আমি তাঁর বাড়ি থেকে পড়াশুনা করতাম। জনাব মুনাওওর আলী ছিলেন একমাত্র ব্যক্তি যিনি পূর্ব পাকিস্তানকে (বাংলাদেশকে) খন্ডিত হিসেবে গ্রহণ করতে প্রস্তুত ছিলেন না। তিনি জিন্নাহ সাহেবের কাছে টেলিগ্রামের মাধ্যমে পূর্ব পাকিস্তানকে খন্ডিত হিসেবে গ্রহণ না করার জন্য বলেছিলেন। আমি নিজেই এই টেলিগ্রামটি করেছি। ভারত পাকিস্তান সৃষ্টি হওয়ার পর তিনি পাকিস্তান শাসন ব্যবস্থার একটি খসড়া দিয়েছিলেন। এই খসড়াটি ছিল একটি গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থার রূপরেখা। তা যদি অনুসরণ করে পাকিস্তানের শাসন ব্যবস্থা চলত তাহলে পাকিস্তানের এই দুরবস্থা হত না।’ জনাব মো: আব্দুজ জহুর সুনামগঞ্জের রাজনৈতিক আকাশে এক উজ্জ্বল নক্ষত্র ছিলেন। জনাব মুনাওওর আলী (সুনামগঞ্জের প্রথম মন্ত্রী) সম্পর্কে তাঁর স্মৃতিচারণমূলক নিবন্ধটি সুনামগঞ্জের আজকের প্রজন্মের কাছে এক দলিল হিসেবেই ধরে নেয়া যায়। সুনামগঞ্জের ইতিহাস ঐতিহ্য জানতে আজকের প্রজন্মের কাছে নি:সন্দেহে সহায়ক নিবন্ধ হিসেবেই কাজে লাগবে। আর এটাও ঠিক যে মুনাওওর আলী শুধু সুনামগঞ্জের সম্পদই ছিলেন না, তিনি ছিলেন তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান তথা আজকের বাংলাদেশেরও সম্পদ। কারণ জিন্নাহ সাহেবের কাছে তিনি যে টেলিগ্রামটি পাঠিয়েছিলেন তা শুধু সুনামগঞ্জের মানুষের মঙ্গলের জন্যই ছিল না। ছিল সারা বাংলাদেশের মানুষের মঙ্গলের জন্য। তথা তৎকালীন সারা পাকিস্তানের মঙ্গলার্থে।
সুনামগঞ্জের আজকের প্রজন্ম জানে যে, সুনামগঞ্জ জেলার (তৎকালীন মহকুমা) প্রায় সবগুলো থানা সদরের সাথেই সুনামগঞ্জের সদরের বা সিলেটের সড়ক যোগাযোগ হয়েছে। তবে বর্ষাকালে শাল্লার সঙ্গে এখনও মটরযান যোগাযোগ এর ব্যবস্থা করা সম্ভব হয়নি। কিন্তু এ কথাটি আজ সকলের জানা জরুরী যে ১৯৩৪-১৯৩৫ সাল তথা সুনামগঞ্জের প্রথম মন্ত্রী মুনাওওর আলী যখন মন্ত্রী ছিলেন তখন সুনামগঞ্জ মহকুমার ১৪০০ বর্গমাইলের মধ্যে এক ইঞ্চি মটরযান চলাচলের রাস্তা ছিল না। ১৯২৭ সালের ২ জুলাই জনাব মুনাওওর আলী আসাম কাউন্সিলে প্রস্তাব করেন যে, ‘সিলেট ও সুনামগঞ্জের মধ্যে সারা বছর চলাচলের উপযোগি যোগাযোগের স্থায়ী ও দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণের লক্ষে এই কাউন্সিল আসাম সরকারের নিকট সুপারিশ করছে। ’ বিষয়টির গুরুত্ব বুঝাতে গিয়ে তিনি বলেছিলেন, সুনামগঞ্জ যদি নিজেকে প্রজাতন্ত্র ঘোষণা করে তাহলে সরকার কি করবে? সরকার কোন অবস্থায়ই অন্তত: দু’দিনের আগে সেখানে সৈন্য পাঠতে পারবে না। আর এই দু’দিন আমরা শাসন করতে পারবো।’ তাঁর এই বক্তব্য থেকে কারো বুঝতে কোন অসুবিধা হবার কথা নয় যে তিনি কতটুকু স্বাধীনচেতা ছিলেন।
প্রয়াত মুনাওওর আলী শিক্ষা, কৃষি, বন, আবগারি, ও রেলমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে কতো ব্যস্ততার মধ্যে তিনি দিন কাটাতেন তা সহজেই অনুমেয়। এর মধ্যেও তিনি সাহিত্য চর্চা করতেন। ২৮-১১-৪১ ১২.৩০ ঘটিকায় শিলং বসে যে কবিতাটি লিখেন তা দিয়ে আজকের লিখার সমাপ্তি টানছি। কবিতাটি Ñ
নিজের তারা খোঁজ পেয়েছে ভারতবাসী আজ জেগেছে, (তাদের) মুর্ত্ত জাগনে এসেছে ভারতবাসীর চোখ ফুটেছে, (সারা বিশ্ব) তাদের পানে চেয়ে আছে, (তাদের) স্বাধীনতার দিন এসেছে। আজাদী তার আসছে জোদ ই , আজাদী সে আসছে, খোদ ই।
লেখক: মুক্তিযোদ্ধা, কলামিষ্ট, সাবেক ব্যাংকার।
- হায়দার আলীর স্বপ্ন
- নেদারল্যান্ড, বেলজিয়াম ও লুক্সেমবার্গে