সড়কে নিরাপদে চলার সুযোগ চাই

মঙ্গলবার জেলার বিভিন্ন সড়কে প্রাণ গেছে তিন জনের। এরমধ্যে সিলেট-সুনামগঞ্জ সড়কে একটি যাত্রীবাহী সিএনজি চালিত অটোরিক্সাকে পিষ্ট করেছে বিপরীত দিক থেকে আসা ট্রাক। ঘটনাস্থলেই প্রাণহানি হয়েছে দুই যাত্রী ও এক পথচারীর। নিহতরা হলেনÑ শান্তিগঞ্জের উপ্তিয়ারগাঁও গ্রামের নাছির আলম ও জগন্নাথপুরের হাদিউর ইসলাম কামালী। নিহত পথচারীর নাম জানা যায়নি। গুরুতর আহত হয়েছেন আরও দুইজন। অপর দুই দুর্ঘটনায় দুই ব্যক্তি গুরুতর আহত হয়েছেন। প্রতিদিন সড়ক দানবের আক্রমণে নিহত-আহত হওয়াদের ভিড়ে মঙ্গলবার নতুন করে যুক্ত হলেন এরা। বাংলাদেশের সড়কগুলো হয়ে উঠেছে মৃত্যুসরণী। এই সড়ক দিয়ে চলাচলকারী কারও পক্ষে বলা সম্ভব নয় তারা জীবিত বাড়ি পৌঁছাতে পারবেন কিনা। সারা দেশে সড়ক দুর্ঘটনাজনিত ঘটনাবলী নিয়ে বহু আলোচনা হয়েছে, সুপারিশ এসেছে, আইন বদলেছে। কিন্তু এ সবের সাথে পাল্লা দিয়েই বাড়ছে মৃত্যু। মানুষ এখন সড়কে চলতে ভয় পায়। অথচ প্রয়োজনে ঘর থেকে বের না হয়েও থাকা যায় না। নিতান্ত বাধ্য হয়ে মৃত্যুসরণী দিয়ে চলাচলকারী মানুষ জীবন হাতে নিয়েই পথে নামেন।
সড়কে মৃত্যু না কমার কারণ অনেক। প্রধান কারণ হলো আইন না মানা। মহাসড়কে সিএনজি অটোরিক্সাসহ স্বল্পগতির যানবাহন চলাচল সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। কিন্তু সড়কে এইসব যানবাহনেরই দাপট বেশি। কোনো যানবাহনই সড়কে নির্ধারিত গতিসীমা মানে না। এক গাড়ি অপর গাড়িকে অতিক্রম করতে বেছে নেয় ঝুঁকিপূর্ণ ওভারটেক। সিএনজিগুলো দ্রুত গন্তব্যে পৌঁছাতে অন্য গাড়ির চিপাচাপা দিয়ে চলে যাওয়ার চেষ্টা করে। দক্ষতা অর্জনের আগেই চালকের আসনে বসে পড়ে আনাড়ী লোক। বেশি ট্রিপ দিতে গিয়ে ক্লান্ত চালকের মনযোগের ঘাটতি তৈরি হয়, চোখ ঘুমে জড়িয়ে যায়। আনফিট গাড়ির মিছিল সড়কে। সড়কে বসে হাট। পথচারীরা অসতর্কভাবে সড়ক পাড়ি দেয়। কোনো কোনো সড়ক ও সেতু থাকে ভাঙ্গাচুড়া, সরু। এ সবের কারণে সড়কের দুর্ঘটনা এখন হয়ে গেছে নিয়মিত ঘটনা। এর প্রতিটির জন্যই রয়েছে আইন। আছে আইন মান্যতা দেখার প্রতিষ্ঠান। কিন্তু কোথায় কী। কাগজের আইন কাগজেই সীমাবদ্ধ। বাস্তব প্রয়োগ নেই। এভাবেই চলছে আমাদের মৃত্যু-আতঙ্ক নিয়ে পথ চলা। কতদিন চলবে কেউ বলতে পারে না।
একটি মৃত্যু রাষ্ট্রের কাছে একটি সংখ্যা কেবল। কিন্তু যে লোকটির মৃত্যু হয় তার পরিবার পরিজন জানে এ হলো তাদের সর্বস্ব হরণ। নিহতের পরিবার সারাজীবন এই শোক নিয়ে চলে। যদি কেউ আহত হন তাহলে তার জীবন হয়ে উঠে নরকের সমান। একদিকে ব্যয়বহুল চিকিৎসা চালাতে গিয়ে ফতুর হতে হয় অন্যদিকে নানা শারীরিক পঙ্গুত্ব নিয়ে মরে যাওয়ার চেয়েও ভয়ংকর অভিশপ্ত জীবন টানতে হয় তাদের। যাদের কারণে এই দুর্ঘটনাজনিত ক্ষয়-ক্ষতি, জীবন নাশ; তারা কেউ কোনো দায় নেয় না। তাদের হাতে যেন ধরিয়ে দেয়া আছে মেরে ফেলার লাইসেন্স। এই অপ্রকাশ্য লাইসেন্সের বলে বলীয়ান হয়ে এরা পরিণত হয়েছে সড়ক দানবে। এই দানবদের হাত থেকে রেহাই নেই কারও।
মঙ্গলবার সুনামগঞ্জের সড়ক দুর্ঘটনায় তিন নিহত ও দুই আহত ব্যক্তির পরিবারের খোঁজ-খবর নেয়ার মতো কেউ নেই। যাদের গেছে মর্মবেদনা বুঝবে কেবল তারাই। অন্যরা, এই রাষ্ট্র, সরকার, প্রতিষ্ঠানসমূহ নির্বিকার। যে সমাজে হত্যাকারী নির্বিকার থাকতে পারে, দাপট দেখাতে পারে সেই সমাজ কখনও এমন দুর্বিনীত, অসংযত, নিষ্ঠুর, অমানবিক কর্মকা- থেকে নিবৃত্ত হতে পারে না। সুতরাং এমন করুণ মৃত্যু আমাদের চেয়ে চেয়েই দেখে যেতে হবে। তারপরেও সড়কে চলাচলকারী সকলের মনের একটাই আকুতিÑ সড়কে নিরাপদে চলতে চাই। এই আর্তি কখন ক্ষমতাবানদের বরফের মতো কঠিন ও শীতল, পাথরের মতো শক্ত-নিরস মনোভাবকে আর্দ্র করবে? আর কত মৃত্যু হলে পরে সড়ক হবে নিরাপদ?