আকরাম উদ্দিন
আউল-বাউল মরমী কবির দেশ সুনামগঞ্জ। এখানে রয়েছে লোকসংস্কৃতির গৌরব গাঁথা ইতিহাস। ধান্য ফসলের পাশাপাশি রয়েছে বালু, পাথর, মাছসহ প্রাকৃতিক সম্পদে ভরপুর। এ জেলায় এক অধ্যায় জুড়ে রয়েছে অসংখ্য মরমী কবিদের দেদীপ্যমান কৃর্তি। দূর্বীণ শাহ, শাহ আব্দুল করিম, রাধারমণ দত্ত ও হাছনরাজার নাম উলে¬খযোগ্য। এ ছাড়াও রয়েছেন আড়ালে থাকা এক প্রখ্যাত কবি এলাহীবক্স মুন্সী। এ মরমী কবির রয়েছে বিরল প্রতিভা। আমাদের যাঁরা সভ্য সমাজের ধারক-বাহক বলে নিজেদেরকে জাহির করে থাকেন তাঁদের এ ব্যর্থতা, অবহেলা আর উদাসীনতায় যুগ যুগ ধরে আড়াল হয়ে আছেন মরমী কবি এলাহীবক্স মুন্সী। ফলে শত বর্ষেও ফোটে উঠেনি তাঁর আত্মাতিক গানের সুর। এ প্রজন্ম জানতে পারেনি তাঁর জীবন আদর্শ। যিনি অনেক প্রতিভার পেছনে রয়েছেন আড়াল হয়ে। তাঁর জীবনী পর্যালোচনা করলে বেরিয়ে আসবে আতন্দ্রিয়বাদী মরমী কবি এলাহীবক্স মুন্সীর কৃতকর্ম ও আধ্যাত্মিক গানের মাহাত্ম্য। এ প্রজন্মে জানান দিবে মরমী ধারার অসংখ্য গান। হাতের নাগালে পেয়ে যাবে সম্পুর্ণ একজন এলাহীবক্স মুন্সীকে।
এলাহীবক্স মুন্সী হলেন সুশিক্ষিত ও ইসলামী চিন্তাবিদ সময়ের সাহসী নেতা। পিতা-জাকির মামদ, মাতা-সামানের মা। এলাহীবক্স মুন্সী ১৮৬২ ইং সনের ২৩ মে জন্মগ্রহণ করেন সুনামগঞ্জ পৌরসভার তেঘরিয়া গ্রামে। ৭৫ বছর বয়সে ১৯৩৭ ইং সনের ২৩ মে লোকান্তরিত হন সদর উপজেলার ইব্রাহীমপুর গ্রামে। এলাহীবক্স মুন্সীর শিক্ষা জীবন শুরু হয় সিলেটের ফুলবাড়ি মাদ্রাসা থেকে। পরে ভারতের আলীগড় মাদ্রাসা ও দেওবন্দ মাদ্রাসায়। উচ্চ শিক্ষায় ভাল ফলাফলে উত্তীর্ণ হলে পাগড়ি ও সনদ পেয়ে তৎকালীন সময়ে সুনামগঞ্জ জেলায় গৌরব অর্জন করেছিলেন। তিনি মাতৃভাষার পাশাপাশি জানতেন আরবি, ফার্সি, হিন্দি, ইংরেজি ও সিলেটী নাগরি। তিনি বেশী কথা বলতেন ফার্সি ভাষায়। হয়ত বা এটা তাঁর ভাব প্রকাশের সহজ ভাষা ছিল।
শিক্ষা জীবন সমাপ্ত করে দেশে ফিরে আসেন এলাহীবক্স মুন্সী। সমাজে যুগ যুগ ধরে চলে আসা সামাজিক কুসংস্কার দুরীকরণে ব্রতী হলেন তিনি। বৃটিশ শাসন আমলে প্রসবোত্তীর্ণ মায়েদের নাভী কাটতো নাপিত শ্রেণীর লোকজন। এ সময় এ কাজটাকে নিু শ্রেণীভুক্ত সম্প্রদায়ের কাজ মনে করা হতো। ফলে প্রসবিত মাকে অপেক্ষা করতে হতো ৩/৪ দিন পর্যন্ত। এতে নাভীতে পচন ধরত আর ক্ষতসহ নানা রোগের সৃষ্টি হতো। মারা যেতো অনেক মা ও শিশু। যুবতী মেয়েসহ নারীদের হাত পায়ের নক ও চুল কেটে দিতো নাপিত সম্প্রদায়ের লোকজন। এ ছাড়াও নানা কুসংস্কার চলে আসছিল যুগ যুগ ধরে। এসব কুসংস্কারের বিরুদ্ধে ১৩৩২ বাংলার ২১ ভাদ্র আন্দোলন শুরু করেন এলাহীবক্স মুন্সী।
এ আন্দোলন সমাজের বিত্তশালীরা প্রথমে মেনে নিতে পারেনি। তাঁরা সামাজিক নিয়ম টিকিয়ে রাখতে আন্দোলন বন্ধ করতে অপচেষ্টা চালায়। তবুও এলাহীবক্স মুন্সী এ বাঁধা এড়িয়ে ব্যাপক প্রচারণা চালালেন। এক সময় সমাজের লোকজন এলাহীবক্স মুন্সীকে দমাতে গিয়ে এক কঠিন সিদ্ধান্তে উপণীত হলেন। সমাজচ্যুত করা হল এলাহীবক্স মুন্সীকে। এ সময় অনেকেই সরে দাঁড়াল এলাহীবক্স মুন্সীর কাছ থেকে। শিশুদের পাঠদানে জীবিকাও বন্ধ হয়ে যায় এলাহীবক্স মুন্সীর। ঘরে খাবার নেই, পানি নেই, আপনজনও নেই। এহেন অবস্থায় কেটে গেল অনেক দিন। এমন যাতনা তিনি সহ্য করেছেন হাসিমুখে। তবুও প্রচারণা চালিয়ে গেলেন তিনি।
এক সময় সমাজের মানুষের মধ্যে চৈতন্যতা ফিরে এলো। দরদ হলো এলাহীবক্স মুন্সীর প্রতি। ধীরে ধীরে মানুষ আবারও ফিরে আসলো এলাহীবক্স মুন্সীর আহ্বানে। সকলের অংশগ্রহণে এক সময় দূর করতে সক্ষম হলেন সমাজের কুসংস্কার। প্রথমে দূর করলেন তৎকালীন লক্ষণশ্রী পরগনার কুসংস্কার। পরে সুরমা নদীর উত্তরপাড়ের বিভিন্ন এলাকা। পর্যায়ক্রমে বিভিন্ন উপজেলায় কুসংস্কার দুরীকরণে আন্দোলন করেন তিনি।
এই সময়ে তিনি দোয়ারাবাজার উপজেলার বরাকী নামক গ্রামে বিয়ে। ওই গ্রামের মোঃ ফাজিল উদ্দিনের মেয়ে মোছাঃ আরেফিনা বানুকে বিয়ে করেছিলেন এলাহীবক্স মুন্সী। সেখানেও একই নিয়মে আন্দোলন করে সমাজের কুসংস্কার দূর করেন তিনি। পরে ছুটে যান তাহিরপুর উপজেলাসহ অন্যান্য উপজেলার ও গ্রাম-গঞ্জে।
মৃত্যুর ২০ বছর পুর্বে এলাহীবক্স মুন্সী চলে আসেন সায়িত স্থান ইব্রাহীমপুর গ্রামে। সেখানেও শিশুদের পাঠদানের মাধ্যমে জীবিকা নির্বাহ করতেন। জীবনের শেষ পর্যায়ে এসে রচনা করেছেন অসংখ্য আধ্যাত্মিক গান। ও মন এ নিঃশ্বাসের নাইরে বিশ্বাস/মোরেনি তরাইয়া লইবায় গো আল¬া তোর নাম পাক বারি/ডুবিল ডুবিল ভাংগা তরি গো ডুবিল ডুবিল ভাংগা তরি/পাইলাম না পাইলাম না বন্ধু তোমার দরশন/সদায় জ্বলে হিয়া, পন্থের দিগে রইলু চাইয়া/কুল¬ুনফছিন জায়েকাতুল মউত আল¬ায় বলে কুরআনের মাঝে/মনা দিন গইয়া যায়, দরদ ও সালাম বেজ নবী মোস্তফায় রে/হায়রে আমার যতনের পাখি, সুয়ারে পিঞ্জিরায় আয় একবার দেখি/হায়রে সোনার ময়না, হায় রে ময়না যাইবায় রে উড়িয়া/না জানি কি হইব রে মনা, ও মনা হাসরেরও দিন/সঙ্গী যোগাড় কর রে মন, সঙ্গী যোগাড় কর, ডাক দিলে চলিয়া যাইবায় ছাড়িয়া ঘর/হায় রে আমার সোয়া চান পাখি, আমি তরে ডাকি মন রে, ওরে মনা ঘুমাইছ নাকি/হায়রে রুম্মান ফিরিস্তায় তর্জন গর্জন করি পৌঁছিব বন্দায়/আমার পাগল মনার মন চেতন হইলায় না/আল¬¬া বুঝিতে না পারি/ও ভাই কি হইব না জানি/সমন হইল জারি রে পাগেলা মন/বেসরা ফকিরের কাছে যাইও না/ভুলিও নারে আরে বন্দা এ দুনিয়া মিছা ধান্দা/খাক গোরে মিশি যাবে এ চন্দ্র বদন রে/মিছা সঙ্গীর সঙ্গ ছাড়রে মন বাউলা/ও মন ভুলিয়ে যাবে এ সংসার, একদিন হবে ঘোর অন্ধকার/ও আল¬¬া কেমনে হইমু গো পুল পার/ভবের খেলা শেষ হইব, ইসরাফিলের ফুঁকে রে ইত্যাদি।
এসব গান যেসব শিল্পীরা রেডিও টেলিভিশনে গেয়েছেন তাঁরা হলেন, উজীর মিয়া, উস্তাদ এমরান আলী, শাহ আব্দুল লতিফ, আপ্তাব মিয়া, সুবাস উদ্দিন, আকমল বখত বাবু, শাহীন বখত, বাউল তছকির উদ্দিন, রশিদ মিয়া আরও অনেকে।
ইব্রাহীমপুর গ্রামের প্রবীণ মুরব্বী মোঃ আসক আলী (১৪০) বলেছেন, আমি এলাহী বক্স মুন্সীকে দেখেছি, তিনি শিশুদের শিক্ষা দান করতেন অত্র এলাকায়। বর্তমান হুড়ারকান্দা, সৈয়দপুর, ডালাগাঁও, আমপাড়া, নলুয়া, বালিকান্দি, ইসলামপুর ও মঙ্গলকাটা এলাকার বিভিন্ন গ্রামে গ্রামে গিয়ে। এ সময় এলাকায় বাঘের ভয় ছিল বেশী। প্রায় সময় এলাহী বক্স মুন্সীকে বাঘে দেখেও পালাত। সাপেও পালাত। একদিন আমরা দুই ভাইকে সাপে ধাওয়া করছিল। ভাগ্য ভাল ছিল, ওই সময় এলাহীবক্স মুন্সী পাঠদান শেষে বাড়ি ফিরছিলেন। ঠিক সময়ে এলাহীবক্স মুন্সী কাছে এসে উপস্থিত হলেন। এই সময় আমরা বিপদ থেকে বেঁচে গেলাম। তাঁর মাথায় সব সময় পাগড়ি থাকত আর হাতে থাকত তাশবিহ আর ছড়ি। আল¬াহু আকবার বলে বলে রাস্তা দিয়ে হাঁটতেন তিনি। আমাদের শ্রদ্ধা আর অহংকার এলাহীবক্স মুন্সী। তাঁর স্মৃতি রক্ষা করা সকলের দরকার।
এলাকার প্রবীণ মুরব্বী মহি উদ্দিন (৭৫) বলেন, আমি শুনেছি, এলাহীবক্স মুন্সী ছিলেন সুফি সাধক, তাঁর মৃত্যুর পর নামাজে জানাজায় তৎকালীন সময়ে হাজারো মানুষ শরীক হয়েছিল। তিনি গান লিখতেন ও গাইতেন। মানুষ বাংলোয় জড়ো হতো। সারারাত আসর করে গান গাইতেন আর কাঁদতেন। সব শ্রেণীর মানুষকে আদর করতেন, কাছে টেনে নিতেন। এখন আমরাও তাঁর গান গাই। গ্রাম পর্যায়ে এসব গান চর্চা করে আসছি। প্রতি বছর টেলিভিশনের চ্যানেল আসে। মাজারের ছবি তুলে আর তাঁর রচিত গান রেকর্ড করেন। পাকিস্তান আমলে ছাপা হয়েছিল একটি বই। এখন সেই বইয়ের মূখস্থ গান গেয়ে ফিরছি। আমরা চাই কোন হৃদয়বান ব্যক্তি যদি তাঁর গানগুলো সংগ্রহ করে বই আকারে প্রকাশ করতেন, তাহলে তাঁর গানের মর্ম কথা আমাদের অনেক গভীরে নিয়ে যেতো।
ইয়াকুবিয়া দাখিল মাদ্রাসার সুপার মাওঃ কাজী সাহেদ আলী বলেন, এলাহীবক্স মুন্সী ছিলেন উচ্চ শিক্ষিত একজন হক্কানী আলিম। তাঁর হাতের লিখা আমি পড়েছি। তিনি নিজের জন্য কিছুই করেননি। বিদ্যা আর শ্রম উপহার দিয়েছেন জাতিকে। শিশুদের পাঠ দানেই চলত তাঁর সংসার। শেষ জীবনে অনেক অধ্যাত্মিক গান রচনা করেছেন। তিনি এমন এক ব্যক্তি ছিলেন যে তাঁকে নিয়ে গবেষণা করলে সেই সময়কালে আমরা অনেক তথ্য পেতাম। আমি মনে করি তাঁর উত্তরসূরীরা সচেতন ছিলেন না। যার ফলে তাঁর অনেক স্মৃতি সংরক্ষণ করা হয়নি। তারপরও এখনও যে টুকু পাওয়া যায় তা খোঁজে সংরক্ষণ করা প্রয়োজন। এ ব্যাপারে স্থানীয় জনসাধারণসহ সরকারের দৃষ্টি দেয়া উচিৎ। তার একটি মাত্র কারণ আমরা কিংবা আমাদের নতুন প্রজন্মরা অনেক কিছু জানতে পারবে।
ইব্রাহীমপুরের সাজাউর রহমান (৬৫) বলেন, আমি শুনেছি, লক্ষণশ্রী থেকে এসে প্রথমে ঘর বাঁধেন দেওলা বিলের মাঠের উচুঁস্থানে। বর্ষায় যোগাযোগ অসুবিধায় আমার দাদা মোবারক মিয়া এলাহীবক্স মুন্সীকে নিয়ে আসেন বর্তমান মাজারের বাড়িতে। তাঁর বড় ভাই মীর বক্স আগের বাড়িতেই আছেন। তৎকালীন সময়ে এলাহীবক্স মুন্সী এসে এলাকার ধর্মীয় অনুভুতি জাগিয়ে তুলে ছিলেন। তিনি ছিলেন শিক্ষিত ও নিবেদিত প্রাণ। সেই সময়ে বেশ কয়েকটি ভাষায় গান রচনা করেছেন তিনি। তাঁকে নিয়ে গবেষণার যথেষ্ট সুযোগ রয়েছে।
লেখকÑ আকরাম উদ্দিন, সাংবাদিক ও গল্পকার, সুনামগঞ্জ।
- মিডিয়ায় সাফাদির বক্তব্য প্রচার হচ্ছে না কেন: রিজভী
- শোক সংবাদ আব্দুল গফ্ফার